২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

এরদোগানের সাথে ছবি ও উইঘুরদের নিয়ে মন্তব্যে ওজিলের ক্যারিয়ার শেষ

এরদোগানের সাথে ছবি ও উইঘুরদের নিয়ে মন্তব্যে ওজিলের ক্যারিয়ার শেষ। - ছবি : সংগৃহীত

জার্মানির হয়ে বিশ্বকাপ জেতা ফুটবলার মেসুত ওজিল মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই সব ধরনের ফুটবলকে বিদায়ের ঘোষণা দিয়েছেন। তাকে তার প্রজন্মের সেরা ফুটবলারদের একজন মনে করা হয়।

নিজের ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে ক্লাব ও জার্মাানির হয়ে মোট ৬৪৫টি ম্যাচে মাঠে নেমেছেন। তিনি মোট ১১৪টি গোল করেছেন ও ২২২টি গোলে সহযোগিতা করেছেন। ওজিল তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে ইংলিশ ক্লাব আর্সেনাল, জার্মান লিগের ক্লাব শালকে ০৪, ওয়ের্ডার ব্রেমেন, ফেনেরবাখ, স্পেনের রেয়াল মাদ্রিদ, ইস্তানবুল বাসাকসেহিতে খেলেছেন।

তবে বুধবার (২২ মার্চ) ফুটবল থেকে বিদায়ের ঘোষণা এলেও, ওজিল অনেক দিন ধরেই ছিলেন ফুটবলের আলোচনার বাইরে। একটা সময় তার ক্যারিয়ারে ফুটবল ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল রাজনীতি আর সে-সংক্রান্ত আলোচনা।

বর্ণবাদসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তার অবস্থান ও বক্তব্যের জন্য তিনি আলোচিত হয়েছেন বারবার।

জার্মান ফুটবলের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ তুলে ২০১৮ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেন ওজিল।

২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপেও মেসুত ওজিলের ছবি নিয়ে মাঠে আসেন সমর্থকরা। ২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপে জার্মানি গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়।

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া ফুটবলারদের একজন ছিলেন ওজিল।

চীন সরকারের উইঘুর নীতির বিরুদ্ধে একটি মন্তব্য মেসুত ওজিলের জীবন বদলে দিয়েছিল। ইংলিশ ক্লাব আর্সেনালের মুসলিম ফুটবলার ওজিলের বেতন কমিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেয় ক্লাবটি। এরপর, একটা সময় ইউরোপের শীর্ষ ফুটবল থেকে হারিয়ে যান মেসুত ওজিল।

এসব কিছুর শুরু হয়েছিল একটি টুইট থেকে

২০১৯ সালে মেসুত ওজিল উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীন সরকারের নীতির প্রতিবাদ করে একটি টুইট করেছিলেন। তখনই ওজিলকে সাবধান করে দিয়েছিলেন তার কাছের মানুষজন, তার অ্যাজেন্ট এবং তার বন্ধুরা।

চীন বিশ্ব ফুটবলের জন্য একটা বড় বাজার হিসেবে বিবেচিত। চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইবোতে মেসুত ওজিলের ফলোয়ার ছিল ৬০ লাখের মতো, চীনে মেসুত ওজিলে ফ্যান ক্লাবও ছিল, ওই টুইটের পর এসবই হারিয়েছেন ওজিল।

ফুটবল বিশ্বের চীনা বিনিয়োগকারীর সংখ্যাও নেহাতই কম নয়।

কিন্তু চীনের শিনজিয়াংয়ে উইঘুর ও টার্কিক সম্প্রদায়ের মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের একের পর এক তথ্য আসতে থাকে সংবাদমাধ্যমে।

২০২২ সালের শুরুর দিকে ‘শিনজিয়াং পুলিশ ফাইল’ নামে পরিচিত এসব নথি বিবিসির হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল।

ওজিল মনে করেন, এ বিষয়ে কথা বলা তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

এদিকে, তুর্কি বংশোদ্ভূত মুসলিম ফুটবলার মেসুত ওজিল তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের ঘনিষ্ট লোকদের একজন। ওজিলের বিয়েতে ‘বেস্ট ম্যান’ হিসেবে ছিলেন এরদোগান- এতটাই কাছের মানুষ তারা।

চীনের উইঘুর নীতির সমালোচনা করা সেই টুইটের ফল আসতে শুরু করে ধীরে ধীরে।

কী ছিল মেসুত ওজিলের সেই টুইটের পেছনে
২০১৮ সালে বিবিসির একটি তদন্তে বেড়িয়ে আসে, চীনের কড়া নিরাপত্তা সম্বলিত কয়েকটি বন্দিখানায় ১০ লাখেরও বেশি লোককে রাখা হয়েছে, যাদের অনেকেই চীনের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের।

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মেসুত ওজিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্টে উইঘুর মুসলিমদের ‘যোদ্ধা’ হিসেবে আখ্যা দেন এবং চীনের উইঘুর নীতি ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নীরবতার প্রতিবাদ জানান।

ক্লাব আর্সেনাল তখন মেসুত ওজিলের ওই টুইটের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করে বিবৃতি দেয়, ‘আর্সেনাল সবসময়ই একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।’

চীন ধারাবাহিকভাবে উইঘুর মুসলিমদের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছিল।

চীনা কর্তৃপক্ষ একটি বিবৃতিতে বলেছিল যে ধর্মীয় উগ্রতা রুখতে তাদের ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারে রেখে আলাদা প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

ওই পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় প্রো ইভল্যুশন স্কয়ার ২০২০ গেমসের চীনা সংস্করণ থেকে মেসুত ওজিলের নাম সরিয়ে নেয়া হয় প্রথমে। এরপর ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে আর্সেনালের এক ম্যাচের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিল চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সিসি টিভি।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র তখন বলেছিলেন, ‘ওজিল ভুয়া খবরে প্ররোচিত হয়েছেন।’

আর তখন থেকেই ওজিল আর্সেনালের নিয়মিত একাদশে অনিয়মিত হয়ে পড়েন। স্পেনের ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ থেকে আর্সেনালে যোগ দেয়ার পর ২৫৪টি ম্যাচ খেলা ওজিল উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে টুইট করার পরে মাত্র ১০টি ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন। লম্বা সময় তিনি স্কোয়াডেই জায়গা পাননি।

২০২২ সালের অক্টোবরে ওজিল গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমি প্রতি সপ্তাহেই ইতিবাচক ভাবার চেষ্টা করছি, তাই এতদিন ধরে আমি চুপ ছিলাম। আমি আর্সেনালের প্রতি নিবেদিত এবং এটা ভেবেই ২০১৮ সালে চুক্তি নবায়ন করেছিলাম। কিন্তু এর প্রতিদান পাইনি, যা দুঃখজনক।’

তখনই আর্সেনালে ওজিলের সময় কার্যত ফুরিয়ে আসছিল।

জার্মানির বিরুদ্ধে ‘বর্ণবাদের’ অভিযোগ
মেসুত ওজিল ২০১৮ সালের জুলাই মাসে ‘বর্ণবাদ ও অসম্মানজনক’ আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে জার্মানির জাতীয় দল থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন।

ওজিল বিবৃতিতে বলেন, তিনি তুর্কি বংশোদ্ভূত হওয়ার কারণে তাকে অপমান সহ্য করতে হয়েছে।

লন্ডনে ২০১৮ সালের মে মাসে রজব তাইয়্যেব এরদোগানের সাথে একটি ছবি তোলার পর ওজিলকে নিয়ে জার্মানিতে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। রাশিয়ার মাটিতে ওই বছর বিশ্বকাপে জার্মানি গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়, ওজিল জানিয়েছিলেন তখন ইমেইলে প্রচুর ‘ঘৃণাসূচক’ বার্তা পেয়েছিলেন তিনি।

তিনি বলেছিলেন, ‘যখন আমরা জিতেছিলাম তখন আমি জার্মান, কিন্তু হারের পর আমাকে অভিবাসী বলা হচ্ছে।’

জার্মানির হয়ে ওজিল ২০১৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপ জিতেছেন, ২০১১ সাল থেকে তিনি পাঁচবার বর্ষসেরা জার্মান ফুটবলারের পুরস্কার জিতেছেন।

জার্মানির ফুটবল থেকে বিদায় নিয়ে ওজিল তখন লম্বা একটি টুইটার পোস্ট দিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘জার্মান সমাজের জন্য আমি ট্যাক্স দেই, আমি দাতব্য কাজের সাথেও যুক্ত। কিন্তু আমার মনে হয় আমাকে সবাই গ্রহণ করতে পারছেন না।’

মূলত তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপ্রধান এরদোগানের সাথে ওজিলের ওই ছবিই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন।

মেসুত ওজিলের জন্ম জার্মানির গেলজেনকিরশেনে। তিনি তুর্কি বংশোদ্ভূত তৃতীয় প্রজন্মের জার্মান নাগরিক।

জার্মানির ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ও জার্মান লিগ কর্তৃপক্ষও তখন এরদোগানের সাথে ছবি তোলায় ওজিলের সমালোচনা করেছিল।

এরদোগানের সাথে ওজিলের ওই সাক্ষাতের সময় সাথে ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত আরেক জার্মান মিডফিল্ডার ইলকায়ে গুন্দোয়ানও।

গুন্দোয়ান অবশ্য একটি বিবৃতিতে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে লিখেছিলেন, তিনি জার্মানির ভাবমূর্তি সমন্নুত রাখতে শতভাগ মরিয়া এবং কোনো ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশে তিনি এরদোগানের সাথে সাক্ষাৎ করেননি।

কিন্তু ওই সাক্ষাৎ ছিল তুরস্কের জাতীয় নির্বাচনের একটি প্রচারণায়, যা জার্মান কর্তৃপক্ষ ভালোভাবে নেয়নি।

জার্মানির রাজনীতিবিদদের অনেকে জার্মানির প্রতি এই ফুটবলারদের মমতা বা ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। ওই সাক্ষাতের জন্য ওজিল ও গুন্দোয়ান জার্মান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন থেকে কারণ দর্শানো নোটিশ পেয়েছিলেন।

ওজিল তখন বলেছিলেন, ‘এরদোগানের সাথে ব্রিটেনের রাণী দেখা করেছেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে দেখা করেছেন, আমি দেখা করলে সমস্যা কোথায়? এটা রাজনীতি বা নির্বাচনের বিষয় ছিল না, এটা ছিল সম্মানের বিষয়। আমার পরিবার যেখান থেকে এসেছে সেই দেশের সর্বোচ্চ দফতরের সম্মানের বিষয়।’

জার্মানিতে তখন ওই বক্তব্য নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছিল। কারণ জার্মানিতে ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ তুরস্ক থেকে অভিবাসী হিসেবে এসে স্থায়ী হয়েছেন এবং দেশটিতে অভিবাসী ইস্যু সবসময়ই রাজনীতিতে বড় প্রভাব রাখেছে।

ওজিল প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘দেশটা তুরস্ক বলে? আমি মুসলিম বলে?’

ওজিলের ক্যারিয়ার আসলে আর্সেনালেই ২০২১ সালে কার্যত শেষ হয়ে গিয়েছিল, এরপর তিনি ফেনেরবাখে কিছুদিন কাটান এবং শেষ পর্যন্ত ইস্তানবুল বাসাকসেহির থেকে অবসরের ঘোষণা দেন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement