২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

নাটকীয় জয়ে সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা

ডাচদের হারিয়ে কাতার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠেছে আর্জেন্টিনা। - ছবি : সংগৃহীত

নাটক! রোমাঞ্চ! রহস্য! এক মুহূর্তে যেন প্রদর্শনী হলো ফুটবলের লুকানো সৌন্দর্য। রহস্যময় শেষ মুহূর্তটা হার মানাবে যেকোনো থ্রিলার মুভিকে। যেন একইসাথে শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা, মুহূর্তে মুহূর্তে রঙ বদলানো উন্মাদনা, আর দমবন্ধ মুগ্ধতার অপার সমাহার। তবে ষোল আনা শিহরণ ছড়ানো এই ম্যাচে শেষ হাসি হেসেছে আর্জেন্টিনাই। পেনাল্টি শুট-আউটে ডাচদের ৪-৩ গোলে হারিয়ে কাতার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে আকাশী নীলরা।

এদিকে গোল করলেন, করালেন, দলকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও দিলেন; একজন মেসি যতটা করতে পারেন, তার সবটাই ঢেলে দিলেন। তবুও নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষেও হাসতে পারলেন না জয়ের হাসি। অতিরিক্ত সময় শেষে যখন মনে হচ্ছিলো এই বুঝি বাজলো বাঁশি, তখনই বদলে গেল চিত্রনাট্য। আলবিসেলেস্তাদের জালে বল জড়ালো। ফলে ওয়াট ভিগোর্স্টের দ্বিতীয় গোলে ডাচরা অলৌকিকভাবে সমতায় ফিরে।

ফলে শুরু হয় অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলা। যেখানে আক্রমণের পর আক্রমণ চালিয়েও ডাচ রক্ষণকে কাঁপিয়ে দিলেও আর গোলের দেখা পায়নি আর্জেন্টিনা। কখনো ডাচ রক্ষণ, কখনো ডাচ গোল কিপার, আবার কখনো বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল গোলভার। তবে যত ধরনের সুযোগ তৈরি করা যায়, তার সবটাই করে মেসিরা, শেষ ৫ মিনিটে ৭টি কর্নার আদায় করে নেয় তারা। সুযোগ পেয়েছিল নেদারল্যান্ডসও, তবে তারাও তা আর কাজে লাগাতে পারেনি। ফলে এবার খেলা গড়ায় পেনাল্টি শুট-আউটে।

কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে হাই ভোল্টেজ ম্যাচে লড়েছে এ দুই দল। নাটকের চেয়েও বেশি নাটকীয় ছিল আজকের কোয়ার্টার ফাইনালের দ্বিতীয় এ ম্যাচটি।

আর্জেন্টাইনদের স্কোয়াডে প্রথমে ছিলেন না ডি মারিয়া, তবে ফিরেছেন মিডফিল্ডার রদ্রি ডি পল। পাঁচজন ডিফেন্ডার নিয়ে আজ শুরুর একাদশ সাজিয়েছিলেন লিওনেল স্কোলোনি। রক্ষণভাগ সামলাতে ছিলেন ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো, নিকোলাস ওতামেন্দি, লিসান্দ্রো মার্টিনেজ, মার্কোস আকুনা ও নাহুয়েল মলিনা। তবে ডি মারিয়াকে মাঠে নামানো হয়েছিল ম্যাচের শেষদিকে।

বিপরীতে ডাচদের তিনজনের আক্রমভাগে আজ ভিন্নতা এনেছিলেন লুই ভ্যান হাল, কোডি গাকপোকে মাঝে রেখে তার দুই পাশে দুই ফ্ল্যাংকে খেলেছেন মেম্ফিস ডিপাই ও স্টিভেন বার্গউইন।

ম্যাচের প্রথম ৩০ মিনিট সমানে সমানে লড়েছে দুই দল। কিন্তু কোনো দলই একে অপরের গোলপোস্ট বরাবর শট নিতে পারেনি। দু’দলই শুরু থেকে ছোট ছোট পাসে খেলছে। উভয়েই রক্ষণভাগ জমাট রেখে খেলেছে প্রাণপণে।

তবে ম্যাচের ৩০ মিনিটের পর থেকে আর্জেন্টিনা বলের নিয়ন্ত্রণ ও আক্রমণে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। ৩৫ মিনিটের মাথায় অবশেষে ডেডলক ভাঙে আর্জেন্টিনা। লিওনেল মেসির বাড়ানো অনবদ্য ফরোয়ার্ড পাস থেকে বল রিসিভ করেন নাহুয়েল মলিনা। ডাচদের গোলকিপার নোপার্টকে পরাস্ত করে ডিবক্সের ভেতর থেকে নেয়া শটে জালে বল জড়ান মলিনা। এটি জাতীয় দলের জার্সিতে মোলিনার প্রথম আন্তর্জাতিক গোল। এছাড়া এই নিয়ে বিশ্বকাপে নকআউট পর্বে এটি ছিল মেসির পঞ্চম অ্যাসিস্ট। এই অ্যাসিস্টের সুবাদে ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলের নক আউট পর্বে করা চার অ্যাসিস্টের রেকর্ডটি ভেঙে নতুন রেকর্ড গড়লেন তিনি।

এই গোলটি হওয়ার পরপরই খেলার উত্তাপ বাড়তে থাকে। ম্যাচে হলুদ কার্ডের বন্যা বয়ে যেতে শুরু করে। প্রথমার্ধের শেষদিকে হলুদ কার্ড দেখেন জুরিয়েন টিম্বার ও মার্কোস আকুনা। কিছুক্ষণ পর হলুদ কার্ড দেখেন আরেক আর্জেন্টাইন ক্রিশ্চিয়ান রোমেরো। শেষ ৫ মিনিট ও অতিরিক্ত সময় মিলিয়ে মোট তিনটি ফ্রি কিক পায় নেদারল্যান্ডস। কিন্তু একটিও কাজে লাগাতে পারেনি অরেঞ্জ আর্মিরা।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই এবারে বেশ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে ডাচরা। দুই ফ্ল্যাংক থেকে ডিপাই ও বার্গউইন আক্রমণের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করলেও সুবিধা করতে পারছিলেন না। ৬৩ মিনিটের মাথায় এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এসেছিল আর্জেন্টিনার। সে সময় একটি ফ্রি কিক পেয়ে যায় দলটি। ফ্রি কিক নিতে আসেন লিওনেল মেসি। কিন্তু বারের খানিকটা ওপর দিয়ে চলে যায় তার নেয়া শটটি।

তবে ভক্তদের সেই আক্ষেপ অবশ্য মিটিয়ে দিয়েছেন মেসি কয়েক মিনিট পরেই। ৭১ মিনিট সময়ে অ্যাকুনা বল নিয়ে ডাচদের ডি-বক্সে ঢুকে পড়লে তাকে আটকাতে গিয়ে বক্সের কোণায় ট্যাকেল করে ফেলে দেন ড্যাঞ্জেল ডেমফ্রিস। ফলে পেনাল্টি পেয়ে যায় আর্জেন্টিনা। স্পট কিক থেকে লক্ষ্যভেদ করেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক লিওনেল মেসি।

কিন্তু খেলার যে তখনো আরো বাকি! ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে নেদারল্যান্ডস তখন রাগে ফুঁসছে। ইতিউতি গোলের সুযোগ খুঁজছে দলটি। ৮৩ মিনিট সময়ে স্টিভেন বার্গহুইসের ক্রস রিসিভ করতে তুফান গতিতে দৌড়ে গোলপোস্টের সামনে পৌঁছে যান ওয়াউট ওয়েগহোর্স্ট। বার্গহুইসের উড়িয়ে মারা শটে মাথা লাগিয়ে হেডে অসাধারণ এক গোল করেন তিনি।

এরপর আক্রমণ আরো বাড়াতে শুরু করে ডাচরা। ৮৯ মিনিটে ডাচ ডিফেন্ডার নাথান অ্যাকে আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার লিওনার্দো পারদেসকে ফাউল করলে রেগে গিয়ে বল টেকনিকাল এরিয়ার দিকে ছুড়ে মারেন পারদেস। মাঠে থাকা ডাচ অধিনায়ক ভার্জিল ভ্যান ডাইক ও দুই দলের রিজার্ভ বেঞ্চের খেলোয়াড়েরা টেকনিক্যাল এরিয়া ছেড়ে মাঠে ঢুকে একে অপরের সাথে তুমুল বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। রেফারি তাদের থামিয়ে দেন, হলুদ কার্ড দেখান পারদেসকে। ম্যাচের সংযুক্তি সময় দেয়া হয় ১০ মিনিট।

সংযুক্তি সময়ের একেবারে শেষ মিনিটে (৯০+১০’ মিনিট) বক্সের বাইরে ফ্রি কিক পেয়ে যায় নেদারল্যান্ডস। বার্গুইসের নেয়া ফ্রি কিক ধরে বাম পা দিয়ে দুর্দান্ত এক গোল করে নাটকীয়ভাবে নেদারল্যান্ডসকে সমতায় ফেরান ওয়েগহোর্স্ট। নেদারল্যান্ডসের বিশ্বকাপ ইতিহাসে বদলি হিসেবে খেলতে নেমে প্রথমবারের মতো জোড়া গোল করার কীর্তি গড়লেন তিনি।

নির্ধারিত সময়ে স্কোরলাইন ২-২ সমতায় শেষ হলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।

অতিরিক্ত সময়ের প্রথম ১৫ মিনিটে তেমন সুবিধা করতে পারছিল না আর্জেন্টিনা। ১১০ মিনিটে আবারো একটি ফ্রি কিক পায় আর্জেন্টিনা, এবারেও বল বারের ওপর দিয়ে পাঠান মেসি। অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে এবারে রীতিমত মরিয়া হয়ে আক্রমণের চেষ্টা করে আর্জেন্টিনা। কিন্তু একের পর এক সব শট বাঁচিয়ে নেদারল্যান্ডসকে রক্ষা করে গেছেন আন্দ্রিয়াস নোপার্ট।

অবশেষে খেলা গড়ায় পেনাল্টি শ্যুট আউটে। শুরুতেই ভ্যান ডাইক ও বার্গহুইসের পেনাল্টি আটকে দিয়ে অসাধারণ সেইভ করেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। একে একে গোল করেন মেসি ও পারদেজ। তৃতীয় শট গোল করেন কুপমেইনার। তৃতীয় শটে গোল করেন মন্তিয়েল। চতুর্থ শট কাজে লাগান সুপার সাব উইগোর্স্টও। কিন্তু বারে লাগায় গোল মিস করেন এনজো ফার্নান্দেজ। লুক ডি ইয়ংয়ের গোলে ৩-৩ সমতায় দুই দল। অবশেষে পেনাল্টি নিতে আসেন লাউতারো মার্টিনেজ। মার্টিনেজের শটেই নিশ্চিত হয় আর্জেন্টিনার সেমিফাইনাল।


আরো সংবাদ



premium cement