২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মরক্কোর তারকা আশরাফ হাকিমি ও তার মায়ের গল্প

মরক্কোর তারকা আশরাফ হাকিমি ও তার মায়ের গল্প - ছবি : সংগৃহীত

মরক্কো দলটি নিয়ে বিশ্বকাপের আগে যতবার আলোচনা হয়েছে, ততবার এসেছে আশরাফ হাকিমির নাম। হাকিমি দলটির সবচেয়ে বড় তারকা।

সবচেয়ে বড় মুহূর্তে তিনি নিজের স্নায়ু নিয়ন্ত্রণে রেখে, পেনাল্টি শট নিয়ে দলের জয় নিশ্চিত করেছেন।

স্পেনের বিপক্ষে ম্যাচ, ১২০ মিনিটের জমাট ডিফেন্সিভ ডিসপ্লের পর স্পেন পেনাল্টি শুটআউটে খেই হারালো।

আশরাফ হাকিমির ওপর দায়িত্ব পড়লো, তিনি গোল করলেই মরক্কো কোয়ার্টার ফাইনালে। তিনি গোল করলেন, স্পেনের কোচ লুইস এনরিকের ‘১০০০ পেনাল্টি’ অনুশীলনের বক্তব্য আক্ষরিক অর্থেই মাঠে মারা গেল।

এমন এক ফুটবলারের পায়ে, যার জন্ম মাদ্রিদে, যিনি রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে খেলেছেনও। এখন খেলছেন ইউরোপের অন্যতম বড় ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ের হয়ে।

মরক্কো ইতিহাসে প্রথম আরব দেশ হিসেবে ফিফা বিশ্বকাপের সেরা আটে জায়গা করে নিয়েছে। মাত্র চতুর্থ আফ্রিকান দেশ হিসেবে এই পর্যায়ে এসেছে দেশটি।

এর আগে ১৯৯০ সালে ক্যামেরুন, ২০০২ সালে সেনেগাল এবং ২০১০ সালে ঘানা কোয়ার্টার ফাইনালে এসেছিল। কিন্তু এর বেশি কোনো দলই যেতে পারেনি।

আশরাফ হাকিমিরা আরো একটি আফ্রিকান দেশ এবং প্রথম আরব দেশ হিসেবে ছুলেন কোয়ার্টারের মঞ্চ। আশরাফ হাকিমি গোল করার পর ছুটে গেলেন গ্যালারির সেই কোণে, যেখানে তার মা আছেন।

বেলজিয়ামের বিপক্ষে মরক্কোর স্মরণীয় জয়ের পরেও এই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। ইন্টারনেটের সবচেয়ে আলোচিত ছবির একটি ছিল আশরাফ হাকিমি ও তার মায়ের ছবি।

মায়ের সাথে আদর বিনিময় করলেন এবং খেলা শেষে মায়ের গল্প বললেন। যেই গল্প ছুঁয়ে গেছে ফুটবল সমর্থক এবং ফুটবলের বাইরেও অনেকের মন।

বিবিসি স্পোর্টসের প্রেজেন্টার মিমি ফাওয়াজ টুইটারে লিখেছেন, আশরাফ হাকিমির মায়ের সাথে আরো একটি দারুণ ছবি। স্পেনকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে হাকিমি ছুটে গেছেন মায়ের কাছে। তার বাবা-মার ত্যাগ সম্পর্কে কথা বলেছেন হাকিমি।

চব্বিশ বছর বয়সী আশরাফ হাকিমি বলেছেন, তার মা মানুষের বাড়ি পরিষ্কার করে অর্থ উপার্জন করতেন একটা সময়। হাকিমির মায়ের নাম সৈয়দা মৌহ। হাকিমির বাবা ছিলেন হকার।

হাকিমি বলেন, আমরা যে পরিবার থেকে এসেছি, আমাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমি এখন প্রতিদিন তাদের জন্য লড়াই করি। তারা আমার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আমার ভাইয়েরা এমন অনেক সুবিধা পাননি যা আমার সফলতার জন্য দেয়া হয়েছে।

হাকিমি একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মরক্কোর এই জাতীয় দলের। যিনি স্পেনের বদলে মরক্কোর হয়েই খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চাইলে তিনি স্পেনেও খেলতে পারতেন।

গোটা মরক্কো এখন আনন্দে উদ্বেল, এমনকি ইউরোপে যেসব বড় শহরে প্রচুর মরক্কান অভিবাসী আছেন তারা গত রাতে পথে নেমে আনন্দ করেছেন।

মরক্কোর কোচ ওয়ালিদ রাগরাগি বলেছেন, এটা একটা দুর্দান্ত প্রাপ্তি। ফুটবলাররা সবাই একাত্ম ছিল এবং শেষ পর্যন্ত দৃঢ়তা দেখিয়েছে।

মরক্কোর সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাদের সমর্থকরা। স্পেনের বিপক্ষে মরক্কোর ম্যাচে গোটা স্টেডিয়ামেই মরক্কোর সমর্থন ছিল লক্ষ্যণীয়।

মরক্কোর রাজা ষষ্ঠ মোহাম্মদ কোচকে ফোন করেছেন ম্যাচের পরে। কোচ ওয়ালিদ রাগরাগি বলেন, মরক্কোর যেকোনো মানুষের জন্য এই ফোন কল পাওয়া বিশেষ একটা ব্যাপার।

মরক্কোর এই কোচ দায়িত্ব পেয়েছেন সেপ্টেম্বর মাসে। এই দু’মাসে তার জীবন বদলে গেছে নিশ্চিত, সাথে বদলে গেল মরক্কোর ফুটবল ইতিহাস।

মরক্কো মঙ্গলবার রাতে কৌশলী ফুটবলের অনন্য এক প্রদর্শনী দেখিয়েছে। তারা স্পেনের বলের পেছনে অযথা ছোটেনি, স্পেন এক হাজারের বেশি পাস দিয়েছে গত রাতে। মরক্কো মাত্র ২৫ শতাংশ বল দখলে রেখে জয় ছিনিয়ে এনেছে শেষ পর্যন্ত।

মরক্কোর সমর্থকদের জন্য বিশেষ এক রাত হাকিমির ঠাণ্ডা মাথার পেনাল্টিকে ফুটবলের ভাষায় বলা হয় ‘পানেনকা’। আলতো ছোঁয়ায় গোলকিপারকে পরাস্ত করেছেন হাকিমি।

স্পেনের গোলকিপার উনাই সিমন ততক্ষণে ঝাঁপ দিয়েছেন, মাটিতে বসেই দেখেছেন বল এখনো ভেসে যাচ্ছে, জালে জড়াচ্ছে।

প্যারিস সেইন্ট জার্মেইয়ে খেলা হাকিমি এখন বিশ্বের সবচেয়ে ভালো রাইট ব্যাকদের একজন, যিনি উইংয়েও খেলেন।

হাকিমির গোল এতো পরিপূর্ণতা পেতো না যদি না তাদের গোলকিপার ইয়াসিন বুনো, দুটি পেনাল্টি ফিরিয়ে দিতেন।

বুনোও গতরাতে যখন নায়কোচিত পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন ম্যাচজুড়ে, তখন উল্লাসে ফেটে পড়েছিল কাতারের এডুকেশন স্টেডিয়ামের হাজারো মরক্কান সমর্থকরা। মরক্কোর কোচ বলেন, যা হয়েছে ভক্তদের শুভকামনা ছাড়া তা অসম্ভব ছিল।

ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ালো মরক্কো ফুটবল দল
কাতার বিশ্বকাপ নানা কারণেই রাজনৈতিক একটা মঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একে তো মুসলিম একটি দেশে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ। তার ওপর ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোর অনেকেই এই বিশ্বকাপ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন খেলা শুরু হওয়ার আগে।

মানবাধিকার, এলজিবিটিকিউ ইস্যু এবং স্টেডিয়াম নির্মাণে শ্রমিকদের মৃত্যু এসব বারবার ঘুরে ফিরে আসছিল আলোচনায়।

কিন্তু ফুটবল শুরু হওয়ার পর মাঠের খেলা নিয়েই আলোচনা বেশি হচ্ছে। এর মাঝেও দলগুলো নিজেদের বার্তা দিয়ে গেছে।

যেমন জার্মানি রংধনু আর্মব্যান্ড পরতে না পারায় মুখ চেপে টিম ফটো তুলেছে। ইরানের ফুটবলাররা চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জাতীয় সংগীত গায়নি।

এবারে মরক্কোর ফুটবলাররা স্পেনের বিপক্ষে জয়ের পরে ফিলিস্তিনের পতাকা নিয়ে উদযাপন করে আরেকটি বার্তা দিল।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement