২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নতুন কোচদের জন্য বাংলাদেশ দল ‘ইন্টার্নশিপের জায়গা’

- ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলের কোচের দায়িত্বে এলেন স্পেনের হাভিয়ের ক্যাবরেরা। তিনি গত ১০ বছরে বাংলাদেশের দ্বাদশ কোচ।

অবশ্য বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে একমাত্র টম সেইন্টফিট ছাড়া কোনো কোচেই জাতীয় দলের কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল না।

অবশ্য শুধু জাতীয় দল নয়, কোনো ক্লাবেও হেড কোচের দায়িত্ব এর আগে পালন করেননি নতুন কোচ হাভিয়ের ক্যাবরেরা।

তবু কেন স্পেনের এই কোচের ওপর ভরসা করলো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন?

বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের কী দেখে মনে হলো যে হাবিয়ের ক্যাবরেরো ফিফা র‍্যাংকিংয়ের ১৮৬তম স্থানে থাকা বাংলাদেশের পুরুষ ফুটবল দলকে সামনে এগিয়ে নেবেন?

কাজী সালাউদ্দিন বলেন, ‘মনে হচ্ছে তিনি অ্যাকটিভ, পুরো ব্যাপারটা সামনে জানা যাবে, কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে ওনার সাথে বাংলাদেশ দল সাফল্য লাভ করবে।’

বাফুফের দায়িত্বশীল কেউই নতুন এই কোচের নিয়োগের পেছনে 'মনে হচ্ছে'র বাইরে তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ বলেননি ।

এর আগেও বাংলাদেশে এমন কোচ এসেছেন যাদের এর আগে জাতীয় দলের কোনো দলের দায়িত্ব ছিল না।

কাজী সালাউদ্দিন বলেছেন, ‘বাংলাদেশ কোচদের জন্য ভালো জায়গা এখান থেকে যদি তারা ভালো রেজাল্ট করে তাদের ক্যারিয়ারটা হাই হয়।’

তবে ‘অতীতে কী হয়েছে’ সেটা নিয়ে কথা বলতে চাননা কাজী সালাউদ্দিন।

অতীতের কোচরা কেমন অভিজ্ঞতার ছিলেন?
অভিজ্ঞ কোচ কিংবা ভালো মানের কোচ আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের অপারগতার একটা বড় কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে বাফুফের যথাযথ লিয়াঁজোর অভাব।

বাংলাদেশের একজন বর্তমান ফুটবলার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে যথাযথ এজেন্টের সাথে যোগাযোগ কিংবা দেশেও ফুটবলে এজেন্ট কালচারটা তেমন শক্তিশালী না। অন্যান্য দেশে এসব নিয়ে ফুটবলাররা মাথা ঘামান না, তাদের কাজ খেলা।’

নেদারল্যান্ডসের কোচ লোডউইক ডি ক্রুইফ বাংলাদেশ জাতীয় দলের দায়িত্ব নেয়ার আগে ও পরে তেমন কোথাওই কোচ হিসেবে কাজ করেননি।

ইতালিয়ান কোচ ফ্যাবিও লোপেজ ২০১৫ সালে দায়িত্ব নেন, তিনিও কখনো কোনো জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব নেননি।

২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রধান কোচের দায়িত্ব পাওয়া স্প্যানিশ গঞ্জালো মোরেনো বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশ তো বটেই কোনো ক্লাবেও কোচিং করাননি, শুধুমাত্র বার্সেলোনার বি-টিমে একসময় খেলতেন এতেই বাফুফে তাকে কোচ করে নিয়ে আসেন। তবে তিনি বার্সেলোনার অ্যাকাডেমিতে কাজ করছেন এখন।

২০১৭ সালে বাংলাদেশের কোচের দায়িত্ব নেন ইংল্যান্ডের অ্যান্ড্রু ওর্ড, তিনিও কখনো বাংলাদেশ ছাড়া কোনো জাতীয় দলের কোচিং করাননি, তিনি চুক্তির মেয়াদ দুই মাস বাকি থাকতেই পারিবারিক কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশ ছাড়েন এবং থাইল্যান্ডের এয়ার ফোর্স ইউনাইটেডের কোচের দায়িত্ব নেন।

বাংলাদেশে তিন বছর কোচের দায়িত্ব পালন করা ইংলিশ কোচ জেমি ডে বাংলাদেশে আসার আগে বেশ কয়েকটি ক্লাবে সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন।

জেমি ডে'র বিদায়ের পর বাংলাদেশেরই ক্লাব ফুটবলের সফল দুই বিদেশি কোচ মারিও লেমোস ও অস্কার ব্রুজনকে টুর্নামেন্ট ভিত্তিক কোচের দায়িত্ব দিয়ে কাজ করান।

এর মধ্যে অস্কার ব্রুজন নিজ ক্লাব বসুন্ধরা কিংসের ফুটবলার নিয়ে দল গড়েই সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলান বাংলাদেশকে। এখন এলেন হাভিয়ের ক্যাবরেরো।

বাংলাদেশের ফুটবল পর্যবেক্ষক নাভিল খান মনে করেন, অনভিজ্ঞ কোচ নিয়ে আসার পেছনে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে, এর মধ্যে একটা বাজেট

তিনি বলছেন, এই নতুন কোচ ক্যাবরেরার বাজেট একেবারেই কম।

‘জেমি ডের সময় বাজেট ছিল, কিন্তু তিনি ফলাফল তেমন দিতে পারেননি।’

নাভিল খান বলেন, ‘এইবার আরেকজন বিবেচনায় ছিলেন স্প্যানিয়ার্ড জেরার্ড নাস। তার প্রোফাইল ছিল ভালো কিন্তু তাকে অর্থের জন্য আনা যায়নি।’

ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব ওয়েস্ট হ্যাম ইউনাইটেডের সাবেক ইসরায়েলী আভ্রাম গ্রান্টের কোচিং প্যানেলে ছিলেন জেরার্ড নাস।

এর আগে কোচরা কে কোন মেয়াদে এসেছেন?
নেদারল্যান্ডসের লোডউইক ডি ক্রুইফ বিভিন্ন মেয়াদে বাংলাদেশের কোচের দায়িত্ব পেয়েছেন। ২০১৩ সালে যোগ দিয়ে ছিলেন ২০১৫ সাল পর্যন্ত।

এরপর ২০১৬ সালেই তিনি মাত্র এক মাস ছিলেন বাংলাদেশের কোচ হিসেবে।

এই ২০১৫ থেকে ২০১৬ এর মধ্যেই বাংলাদেশে তিনজন বিদেশি কোচ এসে চলেও যান।

এই কোচদের বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বেশ আড়ম্বর করে স্বাগত জানায় এবং বিদায়ের সময় সম্পর্কটা তেমন ভালো থাকেনি।

বাংলাদেশে যেসব কোচ গত দশ বছরের মধ্যে দায়িত্ব পালন করেছেন তার মধ্যে টম সেইন্টফিট সবচেয়ে সফল।

তিনি বাংলাদেশে আসার আগেও বেশ কয়েকটি জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বর্তমানে তার দল গাম্বিয়া জাতীয় দল আফ্রিকান নেশনস কাপে ভালো খেলছে।

দু'হাজার আঠারো সালে যখন গাম্বিয়ার দায়িত্ব নেন তখন দলটি ফিফা র‍্যাংকিংয়ে ১৬৬ নম্বরে ছিল, এখন ১৫০তম স্থানে আছে গাম্বিয়া।

বেলজিয়ামের এই কোচ ১৯৯৭ সাল থেকেই কোচিং করিয়ে আসছেন, এখনো পর্যন্ত নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, ইথিওপিয়া, ইয়েমেনসহ মোট নয়টি দেশের প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন।

দু'হাজার ষোল সালে তিনি মাত্র তিন মাস দায়িত্ব পালন করেই ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর কোচের দায়িত্ব নেন।

সে সময় তিনি বলে যান, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে তার সাথে কোনো আলোচনা করেনি।

বিশ্লেষকরা বা ফুটবল লিখিয়েরা অনেক সময়ই বলে থাকেন, নতুন বিদেশি কোচরা অনেক সময় বাংলাদেশকে বেছে নেন 'পোর্টফোলিও ভারি করতে'।

বাংলাদেশের সাবেক ফুটবলার ও বিশ্লেষক ডালিয়া আক্তার মনে করেন, কোনো কোচ কী উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশে আসেন সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি কোচ নিয়োগ দেয়ার সময় বাংলাদেশের ফুটবল কর্তৃপক্ষ কী ভাবছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।

ডালিয়া আক্তারের মতে, নতুন কোচ কিংবা পুরাতন কোচের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য যথাযথ কোচ যিনি সত্যিকারের কাজটা করতে পারবেন।

‘জাতীয় দলে বড় নাম বা বিদেশি কোচ এসবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো অ্যাকাডেমিতে এমন কোচ যারা ফুটবলার তৈরি করতে পারেন।’

তিনি বলেন, এক্ষেত্রে দেশের কোচও ভালো হতে পারে, যেহেতু দেশের কোচদের সাথে ফুটবলারদের বোঝাপড়াটা ভালো। তবে শুধু দেশের কোচ দিয়ে রাখলেও হবে না, তাকে দল গঠনের পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে।

ডালিয়া আক্তার উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশে বেশ কজন কোচ আছেন যোগ্যতাসম্পন্ন যারা টপ লাইসেন্সধারী।’ তাদেরই একজন মারুফুল হক।

মারুফুল হকের মতে, ‘কোচদের নিজস্ব একটা দর্শন থাকে, তারা যখন সেটা ফুটবলারদের দক্ষতার সাথে মেলাতে পারেন না তখনই সংকট তৈরি হয়।’

সরাসরি ফুটবলারদের দোষারোপ করছেন না। তবে তিনি বলেন, এখানে সিস্টেমটাই এমন যে একজন ফুটবলার যথেষ্ট প্রশিক্ষণ এবং যথার্থ প্রস্তুতি ছাড়াই নেহাত খেলতে খেলতে জাতীয় দলে ঢুকে পড়েন।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement