১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দুর্নীতি কমাতে সরকারি চাকুরেদের সম্পদের তালিকা নিতে বলল আইএমএফ

-

দুর্নীতি কমাতে সরকারি চাকরিজীবীদের কাছ থেকে প্রতিবছর সম্পদের তালিকা নেয়া ও তা নিয়মিত হালনাগাদ করার পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পাশাপাশি টাকার প্রবাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণেরও পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। একই সাথে ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের সুদহারের বিষয়ে কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করা ও রেমিট্যান্স প্রণোদনা না দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন ও আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে গত সোমবার রাতে প্রকাশিত সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে এসব পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের চতুর্থ কিস্তি ছাড় পাওয়ার জন্য এসব শর্ত পরিপালন করতে হবে। আর শর্তগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন করা হয়েছে তা মূল্যায়ন করতে আগামী নভেম্বরে আইএমএফের আরো একটি মিশন ঢাকায় আসবে। তাদের প্রতিবেদনের ওপরই নির্ভর করবে চতুর্থ কিস্তি ছাড় হবে কি হবে না।
জানা গেছে, পাঁচ বছর পরপর সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব জমা দেয়ার বিধান ১৯৭৯ সালে চালু হয়। দেশে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারী আছেন। চাকরিজীবীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আচরণ বিধিমালায় এ নিয়ম যুক্ত করা হয়। তবে চার দশকের বেশি সময় ধরে নিয়মটি পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি। অতীতে দেখা গেছে, বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি মন্ত্রণালয় তাদের অধীনে কর্মচারীদের কাছে সম্পদের বিবরণী চেয়েও তেমন সাড়া পায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি কিছু উঁচু স্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
আইএমএফ বলছে, প্রতি বছরই সরকারি কর্মজীবীদের সম্পদের হালনাগাদ তালিকা নিতে হবে। উঁচু-স্তরের দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে, এ বিষয়ে অসম্মতি (নন-কমপ্লায়েন্স) দেখা দিলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। সম্পদের পরিমাণ নিয়মিত হালনাগাদের জন্য একটি মানসম্মত পন্থা অবলম্বন করে সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদ ঘোষণার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে হবে। বহুপাক্ষিক ঋণদানকারী সংস্থাটি আরো বলেছে, দেশে ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতির ক্ষেত্রে সুশাসনের উন্নয়ন এবং দুর্নীতি রোধ ব্যাপক অবদান রাখবে। রাজস্ব ও আর্থিক সুশাসনের উন্নতি, স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং নীতি কাঠামো শক্তিশালীকরণও উন্নত ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

রেমিট্যান্সে প্রণোদনা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে আইএমএফ বলেছে, ‘সাম্প্রতিক সময়ে বিনিময় হার সংস্কারের মধ্যে দিয়ে এ ধরনের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে (বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ আকৃষ্ট করতে) যা অপ্রয়োজনীয়। তাই কর্তৃপক্ষকে এই ভর্তুকি ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে এবং ক্রমান্বয়ে এটি একেবারে বাদ দিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।’ সরকার ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোকে উৎসাহিত করতে ২০১৯ সালের আগস্টে রেমিট্যান্সের ওপর ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এটি বাড়িয়ে ২.৫ শতাংশ করা হয়। আইএমএফ বলছে, ‘আইএমএফ সমর্থিত (ঋণ) কর্মসূচির আগেই সরকার এই প্রণোদনা চালু করেছে, তাই মাল্টিপল কারেন্সি প্র্যাকটিসের (এমসিপি বা বিভিন্ন মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেনের ) ক্ষেত্রে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স ক্রাইটেরিয়নের (পিসি) কোনো লঙ্ঘন হয়নি; তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমসিপিতে আইইএমএফের নতুন নির্দেশিকা কার্যকর হয়েছে।’ এর পরিপ্রেক্ষিতেই রেমিট্যান্সের প্রণোদনা নিয়ে এমন পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটি।
তবে, কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণ করেছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তারা জানিয়েছেন, টাকার প্রবাহ কমানোর অর্থই হলো বিনিয়োগ কমানো। আর বিনিয়োগ কমে গেলে বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধাগ্রস্ত হবে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে আইএমএফের এসব পরামর্শ তেমন ফলপ্রসু হবে না বলে তারা মনে করছেন। অপরদিকে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ। যে পরিমাণ রফতানি হয় বিশেষ করে তৈরী পোশাকের অর্ধের বেশি কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এখন টাকার মান অবমূল্যায়িত করা হলে বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাবে। আর ডলারের দাম বেড়ে গেলে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এতে মূল্যের প্রতিযোগিতায় উদ্যোক্তারা টিকতে পারবে না। অপরদিকে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয়ার কারণেই বেশি অর্থ পাচ্ছে বিদেশে কর্মরত প্রবাসীর সুবিধাভোগীরা। এ কারণে তারা বেশি হারে রেমিট্যান্স পাঠান ব্যাংকিং চ্যানেলে। কিন্তু আইএমএফের পরামর্শে প্রণোদনা তুলে দেয়া হলে আর সেই ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স আহরণ করতে ডলারের দাম না বাড়ালে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো কমে যাবে। সবমিলেই আইএমএফের পরামর্শ বাস্তবায়নে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কাই বেশি বলে মনে করেন বাজার বিশ্লেষকরা।


আরো সংবাদ



premium cement