বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতীয় রেল চলাচলে লাভ কতটুকু
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ২৬ জুন ২০২৪, ০১:৫২
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমানে চলাচল করছে আন্তঃদেশীয় ট্রেন। মৈত্রী, বন্ধন, মিতালী এক্সপ্রেসের পরে দীর্ঘ ৭৭ বছর পর রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে পুনরায় ট্রেন সার্ভিস চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। যেটি হবে দুই দেশের মধ্যে চলাচলকারী চতুর্থ আন্তঃদেশীয় ট্রেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের রেলপথ করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে ভারতীয় রেল ১২টি রুট দিয়ে চলাচল করবে। বাংলাদেশ ও ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষের আশা, এর মধ্য দিয়ে দুই দেশই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। আর বাংলাদেশও পেতে যাচ্ছে ভারতের ভূমি ব্যবহার করে নেপালে রেল সংযোগের মাধ্যমে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের সুযোগ। বাংলানিউজ।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে দীর্ঘ একটা সময় পর ২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিল ঢাকা-কলকাতা রুটে মৈত্রী এক্সপ্রেস নামক ট্রেনের মাধ্যমে দুই দেশের সরাসরি রেল যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। দ্বিতীয় রুট হিসেবে ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর খুলনা-কলকাতা রুটে বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেন চালু করা হয়। আর ২০২১ সালের ২৬ মার্চ তৃতীয় ট্রেন হিসেবে মিতালী এক্সপ্রেস ঢাকা-শিলিগুড়ি রুটে চলাচল শুরু করে।
এ বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, ‘আমাদের যে ইঞ্জিন আছে তা দিয়ে আমরা সপ্তাহে একটা-দুটো ট্রেন সপ্তাহের দুই দিন বা তিন দিন চালাব। আমাদের ব্রডগেজ কোচ স্বল্পতা আছে। এখন ভারতের রেলওয়ের সঙ্গে আমরা আলোচনা করছি, যদি তাদের ব্রডগেজ কোচ এনে সংযোজন করা যায়। রাজশাহী থেকে দর্শনার যে দূরত্ব.. দর্শনা থেকে গেদে বা কলকাতার দূরত্ব কম। এখানে রাজস্ব আয় আমরা বেশি পাব। ’
রেল করিডোর নিয়ে নয়া চুক্তি : গত ২২ জুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৩টি ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার এক নম্বর রয়েছে রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে নতুন ট্রেন সার্ভিস চালুকরণ, ভারতীয় রেল করিডোর নিয়ে নয়া চুক্তি। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৭৭ বছর পর রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে পুনরায় ট্রেন সার্ভিস চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। যেটি হবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চলাচলকারী চতুর্থ আন্তঃদেশীয় ট্রেন। এ ছাড়া এই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে ভারতের কলকাতা থেকে ‘সেভেন সিস্টার্স’-খ্যাত সাত রাজ্যের ১২টি রুটে পণ্য ও যাত্রী চলাচলের সুবিধা।
এ বিষয়ে ভারতীয় রেলওয়ের বক্তব্য নিয়ে বিস্তারিত নিউজ করেছে ভারতীয় পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফ। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন পরিকল্পনার আওতায় মোট এক হাজার ২৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের ১৪টি সেকশন থাকবে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে থাকবে ৮৬১ কিলোমিটার। আর নেপালে ২০২ কিলোমিটার ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকবে ২১২ কিলোমিটার পথ। পত্রিকাটি বলছে, বাংলাদেশ সরকার দেশের ভেতরে ভারতকে রেলপথ স্থাপনের অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় নয়াদিল্লির পরিকল্পনা সহজ হয়েছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে মোট ৮৬১ কিলোমিটার, নেপালে ২০২ দশমিক ৫০ কিলোমিটার এবং উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জরিপ চালানো হবে। ভারতের সঙ্গে এই চুক্তির ফলে ভারতের মাটি ব্যবহার করে বাংলাদেশ রেলওয়ে নেপালেও পণ্য ও যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।
বাংলাদেশের লাভ কতটুকু : ভারতের সাথে রেল করিডোর নিয়ে চুক্তি হওয়ার পরেই সবচেয়ে চর্চিত বিষয় বাংলাদেশের লাভবান হবে কতটুকু! এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যে রেল সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে যোগাযোগের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে চায় তা আদতে একটি ‘ওপেন ডোর’ পলিসি। এ সম্পর্ক উন্নয়নের মূল কথা হলো, ন্যায্যতার ভিত্তিতে সমতাভিত্তিক উন্নয়নের সুযোগ দেয়া। কেউ এগিয়ে যাবে, কেউ পিছিয়ে যাবে, এ নীতিতে আসলে উন্নয়ন স্থিতিশীল হয় না। আঞ্চলিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি চমৎকার ভৌগোলিক অবস্থানে রয়েছে। আমাদের কোস্ট লাইন বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এই সুযোগটি কিন্তু প্রতিবেশী ভারতের সেভেন সিস্টারস, নেপাল বা ভুটানের নেই। সে জায়গায় বাংলাদেশ তার ভৌগোলিক অবস্থানের সুযোগ নিতে পারে। বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো বহুমাত্রিক।
বাংলাদেশ লাভবান হবে কিভাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের যে রেলপথ দিয়ে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ করতে চায়, সে রেলপথের জন্য পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করতে হবে। অন্য একটি দেশের ট্রেন যখন দেশে ঢুকবে, তখন কিন্তু অপারেশনাল ডিজরাপশন তৈরি হবে। তারপর সিকিউরিটির জন্য খরচ আছে। আমার অবকাঠামো অবচয় কত হবে প্রতি বছর সেটি হিসাব করতে হবে। ভারত যে সুবিধা পাবে তা যেন বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানও সমভাবে পায়। আমি যখন আলোচনার টেবিলে বসব, মাশুল নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে, তখন জেনে নিতে হবে প্যাসেঞ্জার বা কার্গো রেল চলাচলে আমাদের হিস্যা কী হবে। কারণ আমরা দেখছি, নৌ বন্দর আর সমুদ্র বন্দরে আমাদের হিস্যা ন্যায্য নয়।
রাষ্ট্রকে জনগণের প্রতি আস্থা তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, অধ্যাপক ড. রহমতউল্লাহ স্যারের তত্ত্বাবধানে বহু বছর আগে একটা সমীক্ষা হয়েছিল। আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে প্রতি বছর ১ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল বাংলাদেশের। এই যোগাযোগ কাঠামোতে আস্থা তৈরি হলে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হবে।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগ নিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, ভারত যদি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহন করতে চায়, তবে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট পলিসির আওতায় আগরতলা-আখাউড়া দিয়ে তা করতে পারবে। কুলাউড়া-শাহবাজপুর রুটের কাজ চলছে। প্রস্তাবিত রুট হিসেবে রয়েছে ফেনী-বিলোনিয়া। বুড়িমারী-চ্যাংড়াবান্ধা, মোগলহাট-গীতলগাও রুটের কথাও ভাবা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে রেলওয়ে মহাপরিচালক বলেন, আগরতলা-আখাউড়া দিয়ে কলকাতা পর্যন্ত সরাসরি ট্রানজিট হবে না। কারণ আখাউড়া থেকে টঙ্গী পর্যন্ত তো মিটারগেজ ট্র্যাক। আমরা চিন্তা করছি, পদ্মা ব্রিজ পার হওয়ার পরে নিমতলীতে অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপো বা আইসিডি করব। সেখান থেকে ট্রান্সশিপমেন্ট করে পণ্য কলকাতায় যাবে। সরদার সাহাদাত আলী বলেন, ভারত থেকে মালবাহী বা প্যাসেঞ্জার যে ট্রেনই চলুক না কেন, আমরা একটা রাজস্ব পাব। ট্যারিফ কমিশন একটা ভাড়া ঠিক করে দেবে। তাতে রাষ্ট্র আর্থিকভাবে লাভবান হবে। এখানে একতরফাভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই। তবে যাত্রীবাহী ট্রেন থেকে মালবাহী ট্রেনে আমাদের সাত-আট গুণ বেশি লাভ হয়।
বেসরকারি সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নতুন ট্রানজিট চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেলপথে সরাসরি পণ্য পরিবহনের সুবিধা পাবে ভারত। এতে ভারতের পণ্য পরিবহন ব্যয় অনেক কমে আসবে। কাজেই তাদের যত টাকা সাশ্রয় হচ্ছে, সেটি বিবেচনায় নিয়ে একটি বেনিফিট শেয়ারিং করা। ধরা যাক, আগে ঘুরপথে ভারতের ৩০ টাকা খরচ হতো, এখন হচ্ছে ১০ টাকা তখন বাকি ১০ টাকা বাংলাদেশকে যদি দেয় তাহলে ভারতের লাভ থাকছে ১০ টাকা, বাংলাদেশেরও লাভ থাকবে ১০ টাকা।
দর্শনা থেকে চিলাহাটি পর্যন্ত যে রেললাইনটিতে ভারত ট্রানজিট পাচ্ছে, সেটা বর্তমানে সিঙ্গেল লাইন রয়েছে। এটি ডাবল না করলে ভারতীয় যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করতে সক্ষম হবে না, সে ক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগ প্রয়োজন বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞরা। এ বিনিয়োগ কিভাবে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে সিপিডির সম্মানীয় এ ফেলো বলেন, এটিতে যেহেতু ভারতও লাভবান হবে, এ ক্ষেত্রে এটি এলওসি ঋণে করলে বাংলাদেশের ওপর বোঝা বাড়বে। সে ক্ষেত্রে দুই দেশের যৌথ বিনিয়োগে প্রকল্পটি হতে পারে। আবার ভারতকে চুক্তিতে শর্ত দিয়ে বহন করানো যায়, তাহলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। কারণ লাইনটি বাংলাদেশও ব্যবহার করতে পারবে।
নৌ চুক্তির ফলে বাংলাদেশ লাভবান হয়নি খুব বেশি, রেলের ক্ষেত্রেও কি এটা হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নৌ চুক্তির ফলে আমরা আশা দেখেছিলাম যে আশুলিয়া নৌ বন্দর ঘিরে কর্মচাঞ্চল্য আসবে, কিন্তু কাস্টমসসহ প্রয়োজনীয় স্থাপনা না করায় সেটা আলোর মুখ দেখেনি। রেলের ক্ষেত্রে আমাদের সুযোগ আছে এর মাধ্যমে নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, আর ট্রানজিট ফিসহ অন্যান্য ফি নিতে হবে।
অতীতে নৌ ট্রানজিট চুক্তি হয়েছে, এখন রেল ট্রানজিট চুক্তি হচ্ছে, এটাতে বাংলাদেশ লাভবান হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো: তৌহিদ হোসেন বলেন, নতুন এই চুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশ লাভবান হবে না, ভারত লাভবান হবে। নৌ চুক্তির সময় বলা হয়েছিল বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের মতো লাভ হবে। কিন্তু পরে কি মিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে?
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা