১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

এখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কেনা হচ্ছে ব্যাংক ইআরএফের আলোচনায় মন্তব্য

ইআরএফের বাজেট আলোচনা সভায় অতিথিরা : নয়া দিগন্ত -

ব্যাংক থেকে টাকা নেয়া হয় ব্যবসা করার জন্য। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে, ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংক কিনে ফেলছে। এই অবস্থায় বিনিয়োগ আশা করা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এনামুল হক। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা গতানুগতিক বাজেট। বাজেটের যে সেøাগান সেখানে খুশি হওয়ার কিছু নেই। গরিবদের খুশি হওয়ার মতো কিছু নেই। ব্যবসায়ীদের জন্যও কিছু নেই। বাজেট বাস্তবায়নে দক্ষতা, আন্তরিকতা ও মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। ড. ফাহমিদা খাতুনের বক্তব্য, প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্যমাত্রাগুলো অসম্পূর্ণ ও অপর্যাপ্ত। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার যেটা প্রয়োজন এখন, তার কোনো উদ্যোগ বাজেটে দেখতে পাইনি। এনবিআরের দুর্বলতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বলতা ও ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতার ব্যাপারে বাজেটে কোনো কথাই বলেননি অর্থমন্ত্রী।
রাজধানীর পুরানা পল্টনে গতকাল ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময়ে আগামী অর্থবছরের বাজেট’ শীর্ষক এক আলোচনায় এমন মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদরা। ইআরএফ সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে ও ইসি কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলামের সঞ্চালনায় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বক্তব্য রাখেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এ কে এনামুল হক , বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. মনজুর হোসেন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন। বাজেট বিশ্লেষণের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট চলমান অর্থনৈতিক সমস্যার গভীরতা মূল্যায়ন করতে পারেনি। তাই বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা তৈরি করতে এবং সমস্যাগুলো দূরীকরণে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে পারদর্শিতা দেখাতে পারেনি। তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, নিম্ন মূল্যস্ফীতি, অধিক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি- বিগত দুই বছরে নেতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা গেছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্নমুখী হয়েছে। সে দিকে লক্ষ্য রেখে বাজেটে মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা ও সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেয়ার দিকে বিশেষ নজর দেয়ার দরকার ছিল। তিনি বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক চাপের সময়, সরকারকে নিম্নস্তরের ভারসাম্য অর্থাৎ নিম্ন মুদ্রাস্ফীতি এবং নিম্ন প্রবৃদ্ধির জন্য মীমাংসা করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় অপারেশন খরচ, অনুৎপাদনশীল প্রকল্প এবং কিছু বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সহায়তার ক্ষেত্রে ব্যয় কমানো প্রয়োজন। সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে দরিদ্র, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের গোষ্ঠীর জন্য উচ্চ বরাদ্দ হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা দেখলাম যে ২০২৪- ২৫ অর্থবছরে যে বাজেটটি ঘোষণা করা হয়েছে সেটি একটি ব্যতিক্রমী সময়ের বাজেট হবার বদলে একটি গতানুগতিক বাজেট হয়েছে। তিনি বলেন, গত দুই বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ এবং দেশে সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে বাজেট ঘাটতি আরো কম রাখা উচিত ছিল। বাংলাদেশে বাজেট ঘাটতি সাধারণত ৫ শতাংশের আশপাশে নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তবে এবার সেটি জিডিপির ৪ শতাংশের মধ্যে রাখা উচিত ছিল। তিনি বলেন, গত ১০ বছর ধরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না। আমাদের চেষ্টা করতে হবে, যেভাবেই হোক রাজস্ব যেন বাড়াতে পারি। রাজস্ব টার্গেট ধরা হয়েছে ৯.৭ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। সেখানে ৮০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি থাকবে। এরকম অবস্থায় যদি ১৪ শতাংশের মতো রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ও আদায় করা কষ্টকর হবে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, উন্নত দেশ, আমরা কতটুক উন্নত, ১২৫টি দেশের মধ্যে ১০৫। পাকিস্তানও আমাদের চেয়ে ইন্টারনেটে এগিয়ে। ইন্টারনেট, মোবাইল, টেলিফোন সব জায়গায় ট্যাক্স। স্পিড নেই, ব্যান্ডউইথ নেই। কিসের উন্নত-স্মার্ট বাংলাদেশ। তিনি বলেন, বাজেটে কিছু প্রায়োরিটি সেট করা দরকার ছিল। মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ, এসব বিষয়ে লক্ষ্য দেয়া দরকার ছিল। ১ লাখ ৩৭ হাজার ব্যাংক থেকে নিয়ে আসলে বেসরকারি খাত ব্যবসা করতে পারবে না। ট্যাক্স আসবে কোন জায়গা থেকে? সামর্থ্যবানদের থেকে ট্যাক্স নেন। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ কর বাড়ান। ভ্যাট বাড়ালে সবার ওপর এর প্রভাব পড়ে। ড. সালেহউদ্দিন বলেন, সরকার হলো সূর্য ও মেঘের মতো। সূর্যের মতো সবাইকে দিতে হবে, আর মেঘের মতো কিছু লোককে সাপোর্ট দেবে। কালিদাসের মেঘনাদ বধ কাব্যে এটা বলা আছে। আমরা পতাকা, ভূখণ্ড, জাতীয় সঙ্গীত পেলেও ভেতরের পিলার নড়বড়ে।
অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, দেশের শিল্পের দেখাশোনা করার জন্য কোনো মন্ত্রণালয় নেই। একজন শিল্পমন্ত্রী আছেন তিনি সরকারি বা রাষ্ট্রের শিল্প-কারখানা দেখেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আছে, সেখানকার মন্ত্রী বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্য দেখেন। দেশের শিল্প দেখবে এমন মন্ত্রণালয় দেশে নেই। তিনি বলেন, বৈদেশিক বিনিয়োগের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বিনিয়োগ আকর্ষণ করার জন্য এখন বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এনামুল হক বলেন, দেশের ধনী লোকেরা সবাই বিদেশে চলে যেতে চায়। বাংলাদেশে ব্যবসা করে বিদেশে গিয়ে সেরা ধনী লোক হয়ে বসে আছেন তারা। যুবকরা বা শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। তার মানে হলো, তারাও দেশে থাকতে চাইছে না। এটা রোধ করতে হলে অর্থনীতিকে রিফর্ম করতে হবে।
মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, নীতি কৌশলের অভাব ও বাস্তব না হওয়ার কারণে নিজের দেশের চামড়া ও পাটের কিছুই করতে পারছি না। এক সময়ের সোনালি আঁশ পাট এখন দুঃখের আশ। চামড়া শিল্পের মতো এ দেশে একটা একটা করে শিল্পের মৃত্যু হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা হতাশ, যারা বৈদেশিক মুদ্রা আনছে তাদের জন্য কোনো পলিসি নেই। অর্থনীতির আকারের সাথে আমাদের রিজার্ভ নিয়ে অশনিসঙ্কেত।


আরো সংবাদ



premium cement