১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ফ্রোজেন গোশত আমদানি বন্ধ, তবে চাপ অব্যাহত

ব্রাহমাসহ উন্নতজাত চান খামারিরা
-

বাংলাদেশে গোশতের উচ্চমূল্যের সুযোগে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আসতো ফ্রোজেন (হিমায়িত) গোশত। যার বেশির ভাগই মহিষের গোশত। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্টে বিক্রি হতো এই গোশত। অপেক্ষাকৃত কম দামে হোটেল মালিকরা কিনে তা রান্না করে ভোক্তাদের খাওয়াতো। যদিও এই গোশতের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকত, বিশেষ করে হালাল হারামের প্রশ্ন উঠতো ভোক্তা মহলে। বৈধ অবৈধ, দুভাবেই আসত এই গোশত। তবে, দেশের খামারিদের স্বার্থে সরকারের কঠোর অবস্থানে ফ্রোজেন গোশত আমদানি বন্ধ হয়ে যায়।

যদিও ফ্রোজেন গোশত আমদানিকারক এবং ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশন থেকে এই গোশত আমদানির অনুমতি পেতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দফতরে চিঠি দেয়া হয়। বিভিন্ন মহল থেকে ফ্রোজেন গোশত আমদানি অনুমতির জন্য চাপ এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে জানা যায়। গত কয়েক বছরে হঠাৎ করেই দেশে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় গরুর গোশতের দাম। ৮০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয় বাজারে। এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় নাগরিক সমাজে। অনেকে গোশত আমদানির পক্ষেও আওয়াজ তোলেন। যদিও খামারি ও প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গো-খাদ্যের দাম বহুগুণ বেড়ে গেছে কয়েক বছরে। এ কারণে উৎপাদন খরচও বেড়েছে। তাই গোশতের দামের এ উচ্চ মূল্য।

২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর গরু রফতানি বন্ধ করে দেয়। হঠাৎ রফতানি বন্ধ করায় বাংলাদেশে গরুর দাম বহুগুণ বেড়ে যায়। এ অবস্থায় গবাদি পশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গুরুত্ব দেয় সরকার। এগিয়ে আসেন শিক্ষিত যুবকরা। তৈরি হয় হাজার হাজার উদ্যোক্তা। কয়েক বছরের মাথায় গবাদি পশুতে ঠিকই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে দেশ। তবে, গো-খাদ্যের দাম বাড়ার প্রেক্ষিতে গোশতের বাজার উর্ধ্বমুখী হয়। সাড়ে ৮০০ টাকা কেজিতেও গরুর গোশত বিক্রি হয়। এ মুহূর্তে এই গোশতের দাম ৮০০ টাকা কেজি। গত বছরের মাঝামাঝিতে গরুর গোশতের এই উচ্চমূল্যের প্রেক্ষিতে দাবি ওঠে ভারত থেকে হিমায়িত গোশত আমদানির। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দফতরে আবেদন করেন ব্যবসায়ী মহল। দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে গরুর গোশত আমদানির অনুমতি চেয়ে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আইবিসিসিআই) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। তিন মাসের মধ্যে ৫০ লাখ টন মহিষের গোশত আমদানির অনুমতি চায় সংগঠনটি। চিঠিতে তারা ভোক্তাদের ৫০০ টাকা কেজিতে গোশত সরবরাহের কথা জানায়।

এর আগে বাংলাদেশে মহিষের গোশত রফতানির অনুমতির অনুরোধ জানিয়ে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন থেকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। চিঠিতে বলা হয়, ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চমানের ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্রক্রিয়াজাত করা গোশতের বৃহত্তম রফতানিকারক। সেটি বাংলাদেশে অপ্রতিযোগিতামূলক। মহিষের গোশত রফতানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোরও অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।

তবে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ী বা আমদানিকারক এবং ভারতীয় হাইকমিশনের এই উদ্যোগ সফল হয়নি। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশ এখন গবাদিপশুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমদানি অনুমতি দিলে খামারিরা পথে বসবে। ডেইরি খাত ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশন। প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্টরা সরকারকে জানিয়ে দেন, হিমায়িত গোশত আমদানিতে বাজারে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। বরং গত প্রায় অর্ধযুগ ধরে দেশে প্রাণিসম্পদ খাতে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন হয়েছে তাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। লোকসানে পড়বেন উদ্যোক্তা ও খামারিরা।

তবে, বসে থাকছেন না ফ্রোজেন গোশত আমদানিকারক ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা। তারা সরকারের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন। নানা কৌশলে গোশত আমদানির চাপ দিচ্ছেন বলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্টরা জানান। এই প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ব্রাজিল থেকে কম দামে গরুর গোশত আমদানির কথা জানান। এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, গোশত আমদানি কেন? ব্রাজিল থেকে গরুর উন্নতজাত আনার ব্যবস্থা করুক সরকার। তাহলে দেশে গোশতের উৎপাদন বাড়বে। দুধের উৎপাদনও বাড়বে।

মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ব্রাহামা আমাদের উপমহাদেশেরই জাত। ১১০ বছর আগে আমাদের এই অঞ্চলেরই তিনটি গরু আমেরিকানরা নিয়ে গিয়ে ‘ব্রাহামা’ জাত তৈরি করেছে। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় ব্রাহামা জাতের গরু খুব ভালো বাড়ে। আমরা এখন ব্রাহামা ব্রিড করছি। দেশের অনেক খামারিই এখন লোকাল ব্রাহামা করছে। সেগুলোর ফলাফলও ভালো। লোকাল ব্রাহামার বৃদ্ধিও ভালো এবং সেগুলো ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে। গোশতের চাহিদা পূরণে ব্রাহমা জাতের গরু উৎপাদনে সরকার এক দশক আগে নানা প্রকল্প নেয়। খামারিরা যখন ব্রাহামা গরু পালন করে গোশতের উৎপাদন বাড়াতে থাকেন, তখনই এটি আমদানি বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্তমানে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর দেশীয় জাতের গরু কৃত্রিম প্রজননের জন্য ৪ ধরনের সিমেন প্রস্তুত করে। আরসিসি বা নর্থ বেঙ্গল গ্রে বা শাহীওয়াল বা মুন্সীগঞ্জ- এসব জাতের গরু থেকে দুধ উৎপাদন করা সম্ভব নয়; শুধু গোশত উৎপাদন করা যায়। এ জাতের একটি ২ বছরের গরু থেকে ১২০-১৫০ কেজি মাংস পাওয়া যায়। অপরদিকে দেশীয় গরুর সাথে এসব জাত সঙ্করায়ন না করে যদি ব্রাহামার মতো উন্নত জাতের সঙ্করায়ন করা হয়, তাহলে ২ বছরের একটা গরু থেকে দ্বিগুণ অর্থাৎ ২৫০-৩০০ কেজি মাংস আহরণ সম্ভব। এ পদক্ষেপেই মাংসের উৎপাদন খরচ অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. কেবিএম সাইফুল ইসলাম বলেন, মুরগির গোশত উৎপাদনের জন্য আমাদের ব্রয়লার আছে। গরুর মাংস উৎপাদনের জন্য গোশত উৎপাদনকারী জাত আছে বিশ্বের সব দেশে। দুর্ভাগ্যবশত আমরা বাংলাদেশে এ রকম কোনো জাত উন্নয়ন করতে পারিনি। শুধু উন্নত জাত থাকায় বাংলাদেশের চেয়ে অর্ধেক খরচে গরুর মাংস উৎপাদন করে ব্রাজিল। প্রাণিজ আমিষের বাজার সহজলভ্য করতে দেশের এমন জাত উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি।


আরো সংবাদ



premium cement