১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

গাজায় আরো এক মেয়র নিহত ইসরাইলের বর্বর হামলা চলছেই

-


ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলি বর্বর হামলায় আরো এক মেয়র নিহত হয়েছেন। নিহত ওই মেয়রের নাম ইয়াদ আল-মাগারি। তিনি গাজার নুসেইরাতের মেয়র ছিলেন। এ দিকে গাজা ভূখণ্ডজুড়ে ইসরাইলের লাগামহীন হামলা অব্যাহত রয়েছে। এসব হামলায় ঘটছে প্রাণহানির ঘটনাও। গতকাল শুক্রবার এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
আলজাজিরার সংবাদদাতা জানিয়েছেন, মধ্য গাজায় ইসরাইলি অভিযানে পাঁচজন নিহত হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে নুসেইরাতের জনপ্রিয় মেয়র ইয়াদ আল-মাগারিও রয়েছেন। পৌরসভা দপ্তরে ইসরাইলি বাহিনী হামলা চালালে তারা প্রাণ হারান। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেয়া এক পোস্টে ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের চেয়ারম্যান রামি নিহত আল-মাগারিকে ‘গাজা উপত্যকার সবচেয়ে সক্রিয় মেয়রদের একজন’ বলে অভিহিত করেছেন।
এ ছাড়া গাজার মিডিয়া অফিস নুসেইরাতের মেয়রকে হত্যার নিন্দা জানিয়েছে। প্রেস অফিস এক বিবৃতিতে নুসেইরাতের মেয়র ইয়াদ আহমদ আল-মাগারির হত্যাকাণ্ডকে ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির লক্ষ্যে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ’ বলে অভিহিত করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আল-মাগারি ‘নিজের দায়িত্ব ও কাজের প্রতি অনুগত ও নিবেদিত’ ছিলেন এবং যুদ্ধের শুরু থেকে পুরোটা সময়জুড়ে নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের লোকদের সহায়তায় নিযুক্ত ছিলেন। এর আগে ইসরাইলি হামলায় দক্ষিণাঞ্চলীয় আজ-জাহরা এবং মধ্য গাজার মাগাজি পৌরসভার মেয়রও নিহত হয়েছিলেন। এ ছাড়া ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজাজুড়ে বেশ কয়েকটি পৌরসভার সদর দফতরও ধ্বংস হয়ে গেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইসরাইলি হামলায় নিহত মেয়ররা ছিলেন পরিশ্রমী ও বিরতিহীন সেবার বিশ্বস্ত উদাহরণ।’
এ দিকে মধ্য গাজার মাগাজি শরণার্থী শিবিরে একটি আবাসিক বাড়িতে ইসরাইলি হামলায় চারজন নিহত এবং আরো ছয়জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে বলে আল জাজিরা জানিয়েছে। অন্য দিকে গত বছরের অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের চলমান আক্রমণে নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা বেড়ে কমপক্ষে ৩৬ হাজার ৬৫৪ জনে পৌঁছেছে বলে বৃহস্পতিবার অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, হামলায় আরো ৮৩ হাজার ৩০৯ জন আহত হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলের হামলায় আরো ৬৮ জন নিহত হয়েছেন বলেও বিবৃতিতে বলা হয়েছে। গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও ইসরাইল অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে তার নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।

উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ইসরাইলি আক্রমণ গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। জাতিসঙ্ঘের মতে, ইসরাইলের বর্বর আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আর খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের তীব্র সঙ্কটের মধ্যে গাজার সবাই এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। এ ছাড়া অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরাইল ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে।
গাজা যুদ্ধ নিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে ‘সত্য’ বলবেন নেতানিয়াহু : রয়টার্স জানায়, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, মার্কিন কংগ্রেসে বক্তব্য দেয়ার সময় তিনি গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ নিয়ে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করবেন। আগামী ২৪ জুলাই ওয়াশিংটন সফরকালে তার কংগ্রেসে বক্তব্য দেয়ার কথা। হাউজ স্পিকার মাইক জনসন এবং সিনেটের মাইনরিটি নেতা (সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশের নেতা) মিচ ম্যাককনেল এক বিবৃতিতে বলেন, প্রতিনিধি পরিষদ এবং সিনেটের যৌথ অধিবেশনে নেতানিয়াহু বক্তব্য দেবেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে চলমান টানাপড়েনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন নেতানিয়াহু। বাইডেন গাজায় ইসরাইলি অভিযানকে সমর্থন জানিয়ে এলেও সম্প্রতি তিনি ইসরাইলি কৌশলের সমালোচনা করেন। কিছু বোমার চালানও স্থগিত করেন তিনি। ইসরাইলকে সমর্থন দেয়ার কারণে নির্বাচনের আগে চাপের মধ্যে আছেন বাইডেন। গাজায় হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কিছুসংখ্যক ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতা এবং ভোটাররা ক্ষোভ জানিয়েছেন। অন্য দিকে ইসরাইলকে সহযোগিতার জন্য বাইডেন যথেষ্ট ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বলে রিপাবলিকানরাও মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে রাশিয়া ও চীনের উদ্বেগ
রয়টার্স আরো জানায়, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র উত্থাপিত একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে বৃহস্পতিবার উদ্বেগ জানিয়েছে ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ রাশিয়া ও চীন। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একটি পরিকল্পনায় সমর্থন চেয়ে প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়েছে। কূটনীতিকরা বলছেন, নিরাপত্তা পরিষদের একমাত্র আরব সদস্য দেশ আলজেরিয়াও প্রস্তাবটিতে সমর্থন দিতে প্রস্তুত নয় বলে ইঙ্গিত দিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাব পাস হতে হলে এর পক্ষে অন্তত ৯টি ভোট পড়তে হয়। তবে প্রয়োজনীয় ভোট পাওয়ার পরও ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচ দেশের কেউ যদি ভেটো দিয়ে দেয়, তবে প্রস্তাবটি পাস করা যাবে না। এক সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গাজায় তিন ধাপে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেন। তিনি একে ইসরাইলি উদ্যোগ বলে উল্লেখ করেন। এই পরিকল্পনার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই পরিকল্পনাটি এখনো হামাসের বিবেচনাধীন।
গত সোমবার জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে এক পৃষ্ঠার খসড়া প্রস্তাব এবং বুধবার এর সংশোধিত অনুলিপি উত্থাপন করা হয়েছে। দু’টি কপিই হাতে পেয়েছে রয়টার্স। বর্তমান খসড়া প্রস্তাবটিতে যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। এটি ইসরাইলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। হামাসকেও প্রস্তাবটি মেনে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে পরিকল্পনাটি পরিপূর্ণভাবে কার্যকরের জন্য দু’পক্ষের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রথম ধাপে গাজা উপত্যকায় একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে লড়াইরত পক্ষগুলোকে তাদের মধ্যকার বৈরিতার স্থায়ী অবসান ঘটাতে হবে। কূটনীতিকরা বলছেন, নিরাপত্তা পরিষদের কয়েকটি সদস্য দেশ প্রস্তাবটি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা প্রশ্ন তুলেছে যে আসলেই ইসরাইল এ প্রস্তাব গ্রহণ করেছে কি না। তারা চায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর এবং জিম্মিদের নিঃশর্ত মুক্তি দেয়ার দাবির ব্যাপারে পরিষদ অটল থাকুক। যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাটি সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। রাশিয়ার সে প্রস্তাবও হাতে পেয়েছে রয়টার্স। মস্কো চায় লড়াইরত পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে অবিলম্বে, নিঃশর্ত ও স্থায়ীভাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হোক। মস্কো আরো চায়, প্রথম ধাপে যুদ্ধবিরতি চলতে চলতেই দ্বিতীয় ধাপের বিষয়ে আলোচনা হোক। মাসের পর মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের প্রতিনিধিরা হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করছেন। হামাস বলছে, তারা গাজা উপত্যকায় যুদ্ধের স্থায়ী অবসান এবং গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলি বাহিনীর প্রত্যাহার চায়।

যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র দিয়ে গাজায় জাতিসঙ্ঘের স্কুলে হামলা ইসরাইলের : এ দিকে সিএনএন জানায়, গাজার মধ্যাঞ্চলে নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের একটি স্কুলে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এতে অন্তত ৪৫ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অস্ত্র ব্যবহার করে ইসরাইল এ হামলা চালিয়েছে বলে সিএনএনের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। স্থানীয় সময় বুধবার রাতে নৃশংস এ হামলা চালানো হয়। শরণার্থী শিবিরের স্কুলটি পরিচালনা করে জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)। হামলার সময় স্কুলটিতে বাস্তুচ্যুত অনেক ফিলিস্তিনি অবস্থান করছিলেন। আহত ব্যক্তিদের কাছের আল-আকসা মার্টার্স হাসপাতালে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে গাজা কর্তৃপক্ষ। হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে ইসরাইলও। ওই স্কুলে হামাসের তৎপরতা ছিল বলে দাবি করেছে তারা। এ দাবি স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে পারেনি সিএনএন। তবে ঘটনাস্থল থেকে ধারণ করা ভিডিও বিশ্লেষণ করে এবং একজন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞের বরাতে মার্কিন সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, এ হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অস্ত্র ব্যবহার করেছে ইসরাইলি বাহিনী। এএফপি প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বৃহস্পতিবার বলেছেন, ইসরাইল গাজার একটি স্কুলে ‘পূর্বসতর্কতা ছাড়াই’ বোমা হামলা চালিয়েছে। স্কুলটি হাজার হাজার বাস্তুচ্যুতের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হয়। ইসরাইলি অধিকার গোষ্ঠী বি’তেসেলেম এই হামলাকে ‘সন্দেহভাজন যুদ্ধাপরাধ’ বলে অভিহিত করেছে। তারা এক বিবৃতিতে বলেছে, যদি ইসরাইলের দাবি অনুযায়ী হামাস স্কুলটিকে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনার জন্য ব্যবহার করেও থাকে, তবু এ পদক্ষেপ বেআইনি। এই দাবি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে স্কুলে আশ্রয় নেয়া বেসামরিক লোকদের ব্যাপক ক্ষতির ন্যায্যতা দিতে পারে না। গোষ্ঠীটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যুদ্ধ বন্ধ করতে সাহায্য করার আহ্বানও জানিয়েছে। ইইউ পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেপ বোরেল এ হামলার তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি এক্সে লিখেছেন, ‘গাজা থেকে বারবার আসা প্রতিবেদনগুলো দেখাচ্ছে, সহিংসতা ও দুর্ভোগ এখনো লাখ লাখ নিরীহ বেসামরিক মানুষের জন্য একমাত্র বাস্তবতা। এই ভয়ঙ্কর খবরটি স্বাধীনভাবে তদন্ত করা উচিত।’

 


আরো সংবাদ



premium cement