১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রেমালের আঘাতে স্তব্ধ সুন্দরবনে ক্ষতি ৬ কোটিরও বেশি, ৫৬ প্রাণীর মৃত্যু

-

ঘূর্ণিঝড় রেমালের আঘাতে বিক্ষত সুন্দরবন এখন শোকে স্তব্ধ। বন কর্মকর্তাদের বর্ণনায় গোটা এলকায় এখন রেমালের ভয়াবহ ছাপ। তাকালে মনে হয় যেন বিবর্ণ এক অচিনপুর। এদিক সেদিক ভেঙে পড়ে আছে গাছপালা। আগের মতো দেখা মিলছে না বাঘসহ বনের প্রাণীদের। নেই গাছে গাছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। ভেসে গেছে সব স্থাপনা। এ পর্যন্ত মৃত উদ্ধার হয়েছে ৫৬টি প্রাণী। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৮ জেটি, ২৬৩০ ফুট রাস্তা ও বাঁধ, ৯টি সড়ক, বনরক্ষীদের ৩টি ব্যারাক, দুটি ওয়্যারলেস টাওয়ার। ভেসে গেছে একটি পন্টুন। ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি টাকারো বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুন্দরবনে জোয়ারে যে পানি হয় তার চেয়ে এবার পাঁচ-ছয় ফুট বেশি পানি হয়েছে। জোয়ারের পানি ছিল দীর্ঘ সময়। এটা প্রাণীদের জন্য খুবই নাজুক অবস্থা তৈরি করে। ঘূর্ণিঝড়ে যে ক্ষতি হয়েছে তা টাকার অঙ্কে নির্ধারণ অসম্ভব। তবে প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী সুন্দরবনে বন বিভাগের ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতির হিসাব বুঝতে আরো সময় লাগবে। কারণ জীববৈচিত্র্য, বন্যপ্রাণী ও গাছপালার যে ক্ষতি হয় তা নিরূপণ করা সময়সাপেক্ষ।
বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বনের ১২ হাজার ৩৫৮টি গাছ ভেঙে পড়েছিল। তখন অবকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল দুই কোটি ১৫ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে বুলবুলের আঘাতে বনের চার হাজার ৫৮৯টি গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৬২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। আর এবার রেমালের আঘাতে ক্ষতির পরিমাণ ছয় কোটি ছাড়িয়ে গেছে। বুলবুল ও আম্পানের চেয়ে রেমালের আঘাতে তিন গুণ বেশি গাছপালা, পশুপাখি, প্রাণী ও অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে। এবারের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অন্তত ৪০ বছর লাগবে।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পুরো সুন্দরবন ডুবে ছিল ৩৮ ঘণ্টারও বেশি সময়। এত দীর্ঘ সময় জোয়ারের পানি থাকায় বন্য প্রাণীদের ক্ষতি বেশি হয়েছে। গত চার দিনে ৫৪টি হরিণ এবং দুটি শুকর মিলিয়ে সুন্দরবনের ৫৬টি মৃত বণ্যপ্রাণী পাওয়া গেছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের (খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলা) কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানান, সেখানে ১৮টি জেটি, ২৬৩০ ফুট রাস্তা ও বাঁধ, ৯টি সড়ক ও বনরক্ষীদের ৩টি ব্যারাক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুটি ওয়্যারলেস টাওয়ার। একটি পন্টুন ভেসে গেছে। এতে ২ কোটি ৬১ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের যে ক্ষতি হয়েছে তা টাকার অঙ্কে হিসাব করা সম্ভব নয় মন্তব্য করে খুলনার বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী সুন্দরবনে বন বিভাগের ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। অন্য দিকে বনের পশ্চিম বিভাগের কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন এর ভাষ্য, এখন বনে পাখি নেই। হরিণও মারা গেছে। অনেক গাছ নষ্ট হয়েছে। যার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। বনের পশ্চিম এলাকায় গরান বন বেশি হওয়ার কারণে বন্য প্রাণীর মৃতের সংখ্যা কম হয়েছে। তবে জোয়ারের পানি সুন্দরবনে গহীনে উঠে যাওয়ায় হরিণগুলো সাঁতরে কূলে উঠতে না পেরে মারা গেছে বলে কর্মকর্তাদের ধারণা।
সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রাণীর মৃত্যু ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বনের ১১ কিলোমিটার গোলপাতা বাগান। পাড় ভেঙে লোনাপানি ঢুকেছে বনের ৫০টি পুকুরে। বন্য প্রাণী এসব পুকুরের মিঠাপানি পান করত। এ ছাড়া বনের মধ্যে ৯টি রাস্তার ২৬৩০ ফুট, ২৫টি জেটি, একটি পন্টুনের বেজ, আটটি সোলার প্লেট, তিনটি ব্যারাক, একটি মধু জাদুঘর, দুটি ওয়্যারলেস টাওয়ার, তিনটি সাইনবোর্ড, তিনটি গোলঘর ও একটি জেনারেটর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৬টি স্টেশন ও টহল ফাঁড়ি থেকে জব্দ করা মালপত্রের আংশিক ভেসে গেছে।
গত ১৭ বছরে কমপক্ষে ১৭টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছে দেশের উপকূলে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরে সুন্দরবনের প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর এলাকার গাছ পুরোপুরি এবং ৮০ হাজার হেক্টর এলাকার গাছ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সময় ৪০টি মরা হরিণ, একটি মরা বাঘ ও একটি মরা তিমি পাওয়া যায়। এবার ঘূর্ণিঝড় রেমালেও নাকাল সুন্দরবন।


আরো সংবাদ



premium cement