সমৃদ্ধ সুলতানি আমলকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন
- শাহেদ মতিউর রহমান
- ৩১ মে ২০২৪, ০০:০৫, আপডেট: ৩১ মে ২০২৪, ০৯:২৭
নতুন শিক্ষাক্রমে সমৃদ্ধ সুলতানি আমলকে খুদে শিক্ষার্থীদের নিকট বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। নবম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১০৪ নং পৃষ্ঠায় বাংলার বেশ কয়েকজন সুবাদারের শাসন আমলকে বিতর্কিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে শাহ সুজা, মীর জুমলা এবং শায়েস্তা খানের আমলের সমৃদ্ধি ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ইতিহাস নিয়ে লুকোচুরি করা হয়েছে। কিছু কিছু ঘটনার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মনে সন্দেহ ও সংশয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
অপর দিকে সুলতানি আমলের বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে ক্লাস সেভেনের বইতে ৬৯ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে দিল্লির মুসলমান শাসকদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বাংলা অঞ্চলের মুসলমান শাসকগণ প্রায় ২০০ বছরের স্বাধীন সুলতান আমল প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। কিন্তু বাংলা অঞ্চলের সম্পূর্ণ ভৌগোলিক অংশে এই ক্ষমতা কখনোই প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেননা বাংলার রাজনৈতিক সীমানার প্রতিনিয়ত বদল ঘটেছে।
আবার ক্লাস নাইনের ১০৪ নং পৃষ্ঠায় সুলতানি আমলের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে মোগল শাসকগণ তাদের অধীনস্থ প্রদেশগুলোর নাম দিয়েছেন সুবা। প্রতিটা সুবায় শাসনকাজ পরিচালনার জন্য একজন করে সুবাদার নিয়োগ করতেন তারা। শাহ সুজা, মীর জুমলা এবং শায়েস্তা খান ছিলেন বাংলার উল্লেখযোগ্য সুবাদার। কথিত আছে যে, শায়েস্তা খান এর আমলে বাংলায় এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। এই ধরনের সাধারণীকরণ তথ্য সম্পর্কে আরো সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। ইতিহাসের এই অংশটুকুকে পাঠ্যবইয়ের আলোচনায় শিক্ষার্থীদের মনে সন্দেহপ্রবণ করে তোলা হয়েছে। যদিও শায়েস্তা খানের আমলের সেই স্বর্ণযুগের কথা ইতিহাসবিদদের মধ্যে সন্দেহাতীতভাবেই সমর্থনযোগ্য। অথচ এখানে বিষয়টিকে নিয়ে বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
এই অধ্যায়ে আরো বলা হয়েছে ইতিহাসের নানান উৎসকে সমালোচনামূলক অনুসন্ধান এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তবেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। পাঠ্যবইয়ের আলোচনা পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় খুবই পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয়, পাঠ্যবইয়ে বাংলার ইতিহাস বর্ণনায় মধ্যযুগের সুলতানি আমলের কথা একেবারেই বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ সেই সময়টা ছিল বাঙালিদের স্বাধীন স্বর্ণযুগ। এই যুগের বাংলায় একত্র হওয়ার প্রয়াস দেখা যায়। এমনকি বাংলা তার সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছে যায়। সেই কথা না বলে শুধু খণ্ডিত বক্তব্য এনে বাংলার তৎকালীন সময়কে বলা হচ্ছে ‘বুলগাকপুর’ (বিদ্রোহী অঞ্চল)।
নবম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১০৩ নং পৃষ্ঠায় আলাউদ্দীন হোসেন শাহের মতো জনদরদি শাসকের চরিত্রও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তার সময়কালে সংগঠিত সমাজ উন্নয়ন ধারাকে অবজ্ঞার সুরে ‘বিশেষ উন্নয়ন’ বলা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ের আলোচনায় আরো বলা হয়েছে হুসেন শাহী শাসনামলে বাংলার শিল্প সাহিত্য ও স্থাপত্যকলার ‘বিশেষ উন্নয়ন’ লক্ষ্য করা যায়। এই সময়ে বাংলার সাহিত্য অঙ্গনে মালাধর বসু, বিজয় গুপ্ত, যশোরাজ প্রমুখ সাহিত্যিকের আবির্ভাব হয়। বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য নামে একটি সাহিত্যধারা চালু হয় মূলত এই সময়েই। আলাউদ্দীন হুসেন শাহ এর শাসনামলে গৌড়ের ছোটোসোনা মসজিদ, বড়োসোনা মসজিদ, বারোদুয়ারি মসজিদসহ অনেকগুলো মসজিদ দুর্গ ও তোরণ নির্মিত হয়।
উন্নয়নের এই আলোচনা সঠিক ছিল যদি আলাউদ্দীন হুসেন শাহের পরিচয়টিই সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হতো। বরং তা না করে পাঠ্যবইয়ের আলোচনায় বলা হয়েছে আবিসিনীয় হাবসি ক্রীতদাসদের একটি দল বাংলার শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছিলেন। চারজন হাবসি ক্রীতদাস প্রায় ছয় বছর বাংলার রাজক্ষমতায় ছিল। একেকজন শাসককে হত্যা করে অন্যজন ক্ষমতায় এসেছিলেন। এরপর হাবসি ক্রীতদাসদের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে ১৪৯৩ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন আলাউদ্দীন হুসেন শাহ। বহু দূর থেকে ভূখণ্ডে এসে তিনি ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্ত অর্থাৎ বাংলা অঞ্চলে এসেছিলেন। তার পূর্ব পুরুষেরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার অধিবাসী। এভাবে ক্ষমতায় দখল করে তিনি শাসন করতে থাকেন। হুসেন শাহ একজন সাম্রাজ্য সম্প্রসারণবাদী শাসক ছিলেন। পাঠ্যবইয়ের এই অংশে বেশ কিছু তথ্য ভুল এবং ইতিহাসের ভুল উপস্থাপন করা হয়েছে। আলাউদ্দীন হুসেন শাহের বাবা উজবেকিস্তানের তিরমিজ শহর থেকে মুর্শিদাবাদের চাঁদপুর মৌজায় এসে বসতি স্থাপন করেন। আলাউদ্দীন ও তার বড় ভাইয়ের শৈশব এখানেই কেটেছে। বাংলার আলো বাতাসেই তিনি বড় হয়েছেন, মানুষ হয়েছেন। এ বিষয়ে যদুনাথ সরকার লিখেছেন,
গড়ংঃ ড়ভ ঃযব ধপপড়ঁহঃং ধমৎবব রহ পধষষরহম যরস ধ নড়ৎহ ধৎধন যিড় রিঃয যরং ভধঃযবৎ, ঝধুুরফ ধংযৎধভ, যধফ ৎবপবহঃষু ংবঃঃষবফ রহ নবহমধষ. ঐরং বধৎষু ষরভব রং ঃযব ঃযবসব ড়ভ সধহু ষবমবহফং ধহফ ভড়ষশঃধষবং, ঃযব সধলড়ৎরঃু ড়ভ যিড়স পবহঃৎব ড়হ ধ ারষষধমব হড়ি পধষষবফ ঊষড়ধহর ঈযধহফঢ়ধৎধ, রহ ঃযব লধহমরঢ়ঁৎ ংঁনফরারংরড়হ ড়ভ ঃযব গঁৎংযরফধনধফ উরংঃৎরপশ.
তথ্য সূত্র : ঝধৎশবৎ লধফঁহধঃয, বফ. (১৯৭৩) ঋরৎংঃ ঢ়ঁনষরংযবফ ১৯৮৪. “ঠওও : ঞযব ঐঁংধরহ ঝযধয উুহধংঃু” ঞযব ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইবহমধষ. ঠড়ষষ, ওও; গঁংষরস চবৎরড়ফ, ১২০০- ১৭৫৭. চধঃহধ: অপধফবসরপধ অংরধঃরপধ.
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো ক্লাস সেভেনের বইয়ে ৬৯ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে মুসলিমরা আসার আগেই বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটেছিল। অথচ এই আলোচনা ঐতিহাসিকভাবেই ভুল। মুসলমান আসার আগে সেন আমলে এ দেশে বাংলাভাষার কী অবস্থা ছিল তার বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায় ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের বক্তব্যে। তার বর্ণনা মতে, ‘শুধু তাহাই নহে, সংস্কৃত ভাষার অত্যধিক আদরে রাজসভা হইতে মাতৃভাষা তাড়িত হইলো। যদি কেহ রামায়ণ বা পুরাণ এর কথা বাঙ্গলা ভাষার প্রচার করে এবং শ্রবণ করে তবে সে রৌরব-নরকে পতিত হয়- ইহাই হইল অনুশাসন “অষ্টাদশ পুরাণনি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানব: শ্রুত্বা রৌরবং নরকং গচ্ছেৎ” (সংস্কৃত ভাষায়)। এভাবে সেন রাজত্বে তাহাদের অধিকৃত নব ব্রাহ্মণ্যে দীক্ষিত জনপদে বাঙ্গলা ভাষা সম্পূর্ণরূপে অনাদৃত ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উপেক্ষিত অবস্থায় ছিল। তথ্যসূত্র: দীনেশ চন্দ্র সেন, প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদান (পড়–য়া, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি-২০১৮) পৃষ্ঠা ৩৬-৩৮।
অপর এক বর্ণনায় এসেছে সেন রাজাদের অত্যাচারে বৌদ্ধরা দেশ ছেড়ে পালালে অল্প কিছু মানুষ ছাড়া কেউই রইলো না বাংলা ভাষা চর্চা করার মতো। সেই অল্প কিছু মানুষ কারা ? এ বিষয়ে ইতিহাসের সাহসী উচ্চারণ করেছেন ড. নীহাররঞ্জন রায়। তিনি লিখেছেন, ইসলামের প্রভাবে প্রভাবান্বিত কিছু লোক বাংলার কোথাও কোথাও সেই পাকৃতধর্মী সংস্কৃতির ধারা অক্ষুণœ রেখেছিলেন। তথ্যসূত্র: নীহাররঞ্জন রায়, বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব (পৃষ্ঠা ১৭৫-১৭৬)।
ক্লাস সেভেনের বইয়ের ৬৯ পৃষ্ঠায় একটি আলোচনায় বলা হয়েছে বাংলা অঞ্চলের বিভিন্ন অংশ শাসনকারী মুসলিম শাসকদের মধ্যে ফকরুদ্দিন মোবারক শাহ, গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ, আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ও নসরত শাহের মতো রাজা/সুলতান কিংবা শাসকদের কেউই কিন্তু বাঙলা ভাষাভাষী ছিলেন না। এ বিষয়ে দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন, মুসলমান বিজয় বাঙ্গলা ভাষার সেই শুভদিন শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হয়ে গেল। তাঁহারা ইরান তুরান যে দেশ হতেই আসুক না কেন বৃঙ্গদেশ বিজয় করে বাঙ্গালী সাজিলেন। তথ্যসূত্র: শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গ ভাষার উপর মুসলমানদের প্রভাব , ‘সওগাত’ ১৩৩৫ সালের চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত।
দীনেশ চন্দ্রসেন আরো লিখেছেন, তুর্কিরা এ দেশে বাস করে এ দেশের একরূপ অধিবাসী হয়ে পড়িয়াছিলেন, তাঁহারা বাঙ্গালা কথা কহিতে ও লিখিতে জানিতেন। তথ্যসূত্র: দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, (দে’জ পাবলিশিং কলকাতা জানুয়ারি ১৯৯৩) খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৯৭৭।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা