১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
নতুন শিক্ষাক্রমের অন্তরালে-১০

ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় নিয়ে ভুল তথ্য

পাঠ্যবইয়ের লেখক নিয়ে প্রশ্ন
-


প্রাচীন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়কাল নিয়ে নবম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে ভুল তথ্যের সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। ইতিহাসবিদদের বর্ণনায় যেখানে বলা হয়েছে- ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়কাল হচ্ছে খ্রিষ্টপূর্ব ৯৩০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৭২০ অব্দে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের নবম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১৪৯ নং পৃষ্ঠায় একটি মানচিত্র দিয়ে দেখানো হয়েছে ইসরাইল রাষ্ট্রটি অতি প্রাচীন একটি রাষ্ট্র। এবং এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সময়কাল দেখানো হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব ৯৫০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫০০ অব্দে। অর্থাৎ ইসরাইল এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার সঠিক সময়ের চেয়ে আরো প্রায় অতিরিক্ত সাত হাজার থেকে সাড়ে সাত হাজার বছরের পুরনো রাষ্ট্র হিসেবে দেখানো হয়েছে নতুন কারিকুলামের নবম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে।
এ দিকে নবম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়কাল নিয়ে বর্ণনায় বলা হয়েছে, বিশ্বের সর্বত্র নগরায়ণের হার সমান নয়। নগরায়ণের একটি বৃহৎ অংশ সেখানে গড়ে উঠতে দেখা যায় যেখানে প্রাচীনকাল থেকে মানুষের থাকার সব উপকরণ সহজলভ্য ছিল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ক্রান্তীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ গোলার্ধে অপেক্ষাকৃত কম নগরায়ণ দেখা যায়। অবশ্য নগরায়ণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উপকূলীয় অঞ্চলে সংগঠিত হয়েছে। অৎঃযঁৎ ঊ ঝসধরষবং তার বিখ্যাত (এবড়মৎধঢ়যু ড়ভ ঞড়হিং) নামক বইয়ে যেসব প্রাচীন নগরের কথা বলা হয়েছে সেগুলোর উৎপত্তি কোনো না কোনো নদী উপত্যকায় হয়েছিল। ইতিহাসবিদদের মতে নগরায়নের সর্বপ্রথম বিকাশ ঘটেছিল দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার জর্দান নদীর উপত্যকায় অবস্থিত জেরিকো নামক স্থানে। এ ছাড়া টাইগ্রিস ইউফ্রেটিস অববাহিকায় সভ্যতাগুলো পৃথিবীর প্রাচীন নগরায়ণের চিহ্ন বহন করছে।
পাঠ্যবইয়ে একটি মানচিত্রে প্রাচীন জেরিকো নগরের অবস্থান চিহ্নিত করতে গিয়ে যেসব রাষ্ট্র ও নগরীর অবস্থান মানচিত্রে চিহ্নিত করা হয়েছে সেখানে দেখানো হয়েছে উত্তরে লেবানন ও সিরিয়া। মাঝ বরাবর পশ্চিমে জেরুসালেম, গাম্বিয়া ও মিসর, পূর্বে সামারা জেরিকা ও জর্দান এবং মাঝবরাবরে জুড়িয়া ও ইসরাইল রাষ্ট্র।
ইতিহাসবিদদের মতে জেরিকো নগরীর কাছে আইন আশ-শামস নামে একটি জায়গাকে প্রথম নগরায়ণের স্থান মনে করা হয়। এর সময়কাল ধরা হয় ৯৫০০- ৬৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব অথবা তারও বেশি আগের । তবে এর সময়কাল নিয়ে নানা মতামত আছে। অন্য দিকে বইতে যে মানচিত্র দেখানো হয়েছে সেখানে এসেছে জুডিয়া ও সামারা। যেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠিত। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ তানাখের বক্তব্য অনুযায়ী রাজা সাউলের (ঝধঁষ) অধীনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর রাজত্ব করেন ডেভিড বা দাউদ আ:, এরপর তার ছেলে সোলাইমান আ:। সোলাইমান আ:-এর মৃত্যুর পর ইসরাইল রাজ্য দুই ভাগ হয়। জুডাহ রাজ্য ও সামারিয়া রাজ্য/ইসরাইল রাজ্য।

আধুনিক ইতিহাসবিদদের মধ্যে এই দুই রাজ্যের সময়কাল হলো খ্রিষ্টপূর্ব ৯৩০ থেকে ৭২০ অব্দ। এরও পরে সিলিউসিডদের বিরুদ্ধে বনি ইসরাইল বিদ্রোহ করে জুডিয়া নামে একটা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গঠন করে খ্রিষ্টপূর্র্ব ১৬৭ এর দিকে। অথচ পাঠ্যবইটিতে আলোচনা করা হচ্ছে প্রথম নগরায়ণের। এর উদাহরণ হিসেবে আনা হচ্ছে জেরিকোর কথা। যেটার সময়কাল হলো আনুমানিক খ্রিষ্ট্রপূর্ব ৬৫০০ থেকে ৯৫০০ অব্দ। এর সাথে আবার দেখানো হচ্ছে জুডিয়া সামারা ইসরাইল অথচ ওই টাইমলাইনে এগুলো ছিল না। এগুলো আরো হাজার হাজার বছর পরের কথা।
অপর দিকে যদি ভুল করে খ্রিষ্টপূর্ব ৯৭০-এর দিকের মানচিত্র দিয়েই দেয়া হয় তাহলে এখানে জেড়িকা আর জুড়িয়াহ এর আশপাশে থাকবে আম্মোন, ইডোম, মোয়াব, আসিরিয়াদের রাজ্যের নাম। ওই সময়ে এগুলো ছিল পার্শ¦বর্তী রাজ্য। এর উদাহরণ হিসেবে পরবর্তীকালের একাধিক মানচিত্র এর দালিলিক প্রমাণ। অথচ নবম শ্রেণীতে যে মানচিত্র দেখানো হয়েছে সেখানে আশপাশের রাজ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে মিসর, সিরিয়া, জর্দান, লেবানন আর গাম্বিয়াকে। যেগুলোর আধুনিক বর্ডার হয়েছে ১৯৪৬ সালের পর। আর ওই সময়টিতে একটি অবৈধ দখরদারিত্ব রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল।
এবার আসা যাক মানচিত্রের বিষয়ে। বইয়ের ১৪৯ পৃষ্ঠায় যে মানচিত্র দেখানো হয়েছে সেখানে ম্যাপের সাইজ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ ছাড়া জুড়িয়া ইসরাইলের অবস্থান ভুলভাবে দেখানো হয়েছে। বানানের ক্ষেত্রেও কিছু বিষয়ের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেমন জেরিকো হয়েছে জেরিকা, জুডিয়া হয়েছে জুড়িয়া। অন্য দিকে নগর প্রতিষ্ঠার সময়কাল নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। প্রাচীন জেরিকো নগরীর প্রতিষ্ঠাকাল আনুমানিক খ্রিষ্ট্রপূর্র্ব ৬৫০০-৯৫০০। জুডাহ/ সামারা দুই রাজ্য প্রতিষ্ঠাকাল আনুমানিক খ্রিষ্ট্রপূর্ব ৯৭০-৭২০। আশপাশের সিরিয়া মিসর লেবানন জর্দানের প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৪৬-এর পরে।
আরো মজার বিষয় হলো এক ছবিতে সব আলোচনা নিয়ে আসা হয়েছে। মানচিত্রের একটি ছবিতেই নিয়ে আসা হয়েছে তিনটি টাইমলাইন আর দুই মহাদেশ। আর এটা করা হয়েছে অবশ্যই একটি উদ্দেশ্য নিয়েই। মূলত প্রথম নগর হিসেবে জেরিকোর আলোচনার মধ্যে জায়োনিস্টদের যে ন্যারেটিভের একটি ম্যাপ নিয়ে আসা হয়েছে। এই জোড়াতালির ন্যারেটিভ ব্যবহার করেই জায়োনিস্টরা তাদের ধ্বংসের প্রকল্পের বৈধতা দেয়। এটা চলে এসেছে আমাদের কোমলমতি শিশুদের পাঠবইয়ে।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে মানচিত্রের মধ্যে জুডিয়াকে লেখা হয়েছে জুড়িয়া নামে। মানে ‘ড’ এর স্থলে ‘ড়’ ব্যবহার করা হয়েছে। আর এই বর্ণ দু’টি ব্যবহারে কারা এমন উলটপালট করতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। অনেকে তামিল নাডুকে (Tamil Nadu) তামিল নাড়– লিখে অভ্যস্ত। একইভাবে ইংরেজি লাডকাকে (Ladka) (ছেলে) লাড়কা বলেও অভ্যস্ত। কাজই এই ভুলটিও তেমনি একটি ভুল বলে মনে করলে এটা অমূলক হবে না। আর বাংলদেশের কারিকুলামের পাঠ্যপুস্তক তথা বাংলাদেশের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য রচিত পাঠ্যবইয়ের লেখক তাহলে কারা এই প্রশ্নও অনেকের মনেই।


আরো সংবাদ



premium cement