১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আনোয়ারুলের লাশের টুকরো পাওয়া যাচ্ছে না

ভারত যাচ্ছে ডিবির প্রতিনিধিদল
-


ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড কে তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। পাওয়া যাচ্ছে না তার লাশের কোন হদিসও। হত্যাকারীরা দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতের মুঠোয় থাকলেও তার লাশ কোথায় ফেলা হয়েছে তা এখনো নিশ্চিত হতে পারছে না। লাশ উদ্ধার করা সম্ভব না হলে বিচার বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা আইন বিশেষজ্ঞদের।
এ দিকে প্রধান অভিযুক্ত পলাতক শাহীনকে গ্রেফতার করা সম্ভব না হলে এই খুনের পেছনে আর কারা জড়িত সেটিও থেকে যাবে অন্ধকারে। কারণ এ পর্যন্ত গ্রেফতারকৃতরা শুধু শাহীনের মিশন বাস্তবায়ন করেছেন বলেই জানতে পেরেছে গোয়েন্দারা। খুনিরাও জানে না শাহীনের পেছনে অন্য কেউ জড়িত আছেন কি না। গোয়েন্দারা বলছেন ‘তারাও এখনো এই খুনের মোটিভ সম্পর্কে পরিষ্কার না। এমন পরিস্থিতিতে ভারতে যাচ্ছেন দেশের গোয়েন্দারা। যার নেতৃত্বে থাকছেন ডিবি প্রধান। এ ব্যাপারে জিও লেটার হয়েছে। এখন আইজিপির দিক-নির্দেশনা পেলেই তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল রওনা হবেন।
গতকাল শনিবার দুপুরে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ভারতীয় পুলিশ বর্তমানে এই হত্যার ঘটনাটি তদন্ত করছে। তাদের একটি দল ঢাকায় রয়েছেন। কিছুদিন পর আমিসহ ডিবির কয়েকজন অফিসার তদন্তের কাজে ভারত যাবো। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হত্যার মোটিভ অনেকগুলো হতে পারে। পূর্বশত্রুতার জেরে হতে পারে, আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত হতে পারে, রাজনৈতিক বিষয়ও থাকতে পারে। এসব বিষয় জানতে তদন্ত চলছে। তবে সঠিক মোটিভ এখনো পাওয়া যায়নি।

গোয়েন্দা এই কর্মকর্তার সাথে একমত আনারের স্বজনরা। তাদের দাবি, আনারকে হত্যা করার মতো সাহস কখনোই শাহীনের হবে না। কারণ আনারের কাছে শাহীন চুনোপুঁটি। এ কারণে শাহীন গ্রেফতার না হলে প্রকৃত মাস্টারমাইন্ড কে তা নিয়ে ধূম্রজাল থেকেই যেতে পারে। যদিও শাহীনকে গ্রেফতার করা অতটা সহজ হবে না বলে মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যরা। কারণ এরই মধ্যে তিনি আমেরিকায় পালিয়ে গেছেন। তদন্তসংশ্লিষ্টদের থেকে জানা গেছে, ২০১৩ সালে এমপি আনারের ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন চুয়াডাঙ্গার ডায়মন্ড ব্যবসায়ী দীলিপ আগারওয়াল। সে সময় তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক বিরোধ হলে ২০১৬ সালে সব ধরনের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন উভয়েই। অভিযোগ রয়েছে, দীলিপের মোটা অঙ্কের টাকা মেরে দেন আনার- এটিও তদন্তে আনা হচ্ছে।
স্থানীয় ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকা যশোর ও ঝিনাইদহ। এই দু’টি এলাকা দিয়ে সব ধরনের চোরাকারবারি হয়ে থাকে। ঝিনাইদহ জেলার চোরাচালানের রুট নিয়ন্ত্রণ করতেন আনায়ারুল আজিম আনার। এ ছাড়া যশোরের সীমান্তগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন সাবেক এক এমপি। মূলত এই সীমান্ত এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছিল স্বর্ণ ও অস্ত্র চোরাচালান এবং হন্ডি কারবারের বিশাল এক সাম্রাজ্য। সেখান থেকে নিয়মিত কমিশন পেতেন আনার ও যশোরের ওই সাবেক এমপি। এই সাম্রাজ্যের অংশীদার ছিলেন ঢাকার মাফিয়ারাও। মূলত ঢাকার মাফিয়াদের মালামালই ওই দুই জেলার সীমান্ত দিয়ে পাচার করা হতো। গত ঈদের আগে চোরাচালন সিন্ডিকেটের প্রায় ১০০ কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে আসে আনারের কাছে।

হত্যার তদন্তকারীরা মনে করছেন, লাশের টুকরো জলাশয়ে ফেলে দেয়ায় তা উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই টুকরোগুলো পানিতে থাকা কোনো না কোনো প্রাণীর পেটে চলে গিয়ে থাকতে পারে। কলকাতা পুলিশকে ‘কসাই’ জিহাদ জানিয়েছে, খুনের পর আনোয়ারুলের দেহ ৮০ টুকরো করে মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ মিশিয়ে দেয়া হয়। হাড়, মাংস পৃথক করে হলুদ মাখিয়ে একেকটি টুকরো একেক জায়গার জলাশয়ে ফেলা হয়েছে।
গোয়েন্দারা আরো বলেন, আনারকে এর আগে দুবার হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে এবং চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে এ খুনের পরিকল্পনা করা হয়। ডিবি প্রধান বলেন, দুইবারের পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়বারের পরিকল্পনায় কলকাতায় তাকে খুন করা হয়। তাদের মূল পরিকল্পনা ছিল সংসদ সদস্যকে হত্যা করা। তবে এর আগে তারা (খুনিরা) চেয়েছিল কলকাতার সেই ফ্ল্যাটে নিয়ে তাকে দুই দিন রেখে ব্লাকমেইল করে কিছু টাকা আদায় করত; কিন্তু অতিরিক্ত চেতনানাশক প্রয়োগের কারণে চেতনা না ফেরায় আগেই সংসদ সদস্যকে খুন করা হয়। এরপর খুনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা সংসদ সদস্যের মুঠোফোন নিয়ে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। লাশ পাওয়া গেল না, তাহলে কিসের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাটিকে মার্ডার বলছেন; এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, এমন ঘটনা আছে যে বছরের পর বছর লাশ পাওয়া যায়নি। তিন বছর লাশ পাওয়া যায়নি, এমন ঘটনাও আমাদের কাছে আছে।
উল্লেখ্য, চিকিৎসার জন্য গত ১২ মে সংসদ সদস্য আনার বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বরানগর থানা এলাকার বাসিন্দা ও তার বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন। পরে ১৩ মে দুপুরে ডাক্তারের সাথে দেখা কথা বলে বের হন। ওইদিন সন্ধ্যায় ফেরার কথা থাকলেও তিনি আর ফিরে আসেননি। পরে গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় একটি নিখোঁজের অভিযোগ করেন গোপাল বিশ্বাস। ১৩ যেকোনো সময় নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসের ফ্ল্যাটে তাকে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। ১৪ মে প্রথম পর্যায়ে এমপির লাশের খণ্ডিত অংশ একটি ট্রলিব্যাগে করে ফ্ল্যাট থেকে বের করা হলেও খুনের বিষয়টি প্রকাশ পায় ২২ মে। এখনো পর্যন্ত আনারের খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

 


আরো সংবাদ



premium cement