ভারতে খুন হলেন ঝিনাইদহের এমপি আনোয়ারুল
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২৩ মে ২০২৪, ০০:০৫
- লাশ পায়নি কোলকাতা পুলিশ
- পরিকল্পিত এ হত্যায় ভারতের কেউ জড়িত নয় : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
- কয়েকজনকে আটক করেছে ডিবি
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোরুল আজিম আনারকে ভারতে হত্যা করা হয়েছে। তবে কলকাতা পুলিশ এখনো তার লাশ উদ্ধার করতে পারেনি। তারা বলছে, গোয়েন্দা তথ্যে জানা গেছে আনোয়ারুল আজিম এমপি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তবে যেখানে এ ঘটনার কথা বলা হয়েছে সেখানে গিয়ে তার লাশ পাওয়া যায়নি। এদিকে এই হত্যায় জড়িত সন্দেহে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের পুলিশ। তাদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই তা বলা যাচ্ছে না। হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে নিবিড়ভাবে তদন্ত চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এদিকে এ হত্যার বিচার দাবি করে এমপি আজিমের মেয়ে ডরিন ফেসবুকে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তাকে ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন। এই ঘটনার বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। অপরদিকে এমপি আনোয়ারুল আজিম হত্যা নিয়ে দিনভর চলতে থাকে নানা গুঞ্জন। কেউ বলেন, তিনি যে হোটেলে উঠেছিলেন ওই হোটেলে আজিমের দ্বিখণ্ডিত লাশ পাওয়া গেছে। আবার কলকাতার ট্যাক্সি চালকের বরাত দিয়ে কেউ বলেন, ‘তার লাশ টুকরো টুকরো করে রাস্তার বিভিন্ন স্থানে ফেলা হয়েছে। তবে রহস্যজনক কারণে তার লাশের হদিস মিলছে না।
কয়েকজনকে আটক করেছে ডিবি : ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ভারতে একজন সংসদ সদস্যকে বাংলাদেশী অপরাধীরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। বিষয়টি নিয়ে আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। এটি নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, এটা মনে করেই তদন্তকারী কর্মকর্তারা কাজ করছেন। ভারতীয় পুলিশের সাথে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রাখছি। তাছাড়া এই ঘটনায় কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তারা আমাদের কাছে আছে, তাদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচ্ছি। কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে আমরা সবকিছু বলতে পারছি না। ঘটনার সাথে জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। এই ঘটনায় নিহতের মেয়ে থানায় মামলা করবেন। আমাদের কর্মকর্তারা তাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছেন। এটা পারিবারিক নাকি আর্থিক নাকি এলাকায় কোনো দুর্বৃত্ত দমন করার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে- সবকিছু তদন্তে আনা হবে।
ধৈর্য ধারণ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী : বাবা আনোয়ারুল আজিম হত্যার বিচারের দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা চেয়েছিলেন নিহতের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন। এরপর তিনি ফেসবুকে লিখেন ‘আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলছেন, তুমি বলেছিলে, আমি চেষ্টা করে খুঁজে পেয়েছি। ধৈর্য ধরো তুমি। বিচার হবে।’
বুধবার বিকেল সোয়া ৩টার দিকে ডরিন তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেয়া এক স্ট্যাটাসে এ তথ্য জানান। এর আগে, দুপুরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে যান ডরিন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি জেনেছি বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। এটা শুনেই আমি ডিবি প্রধানের কাছে এসেছি। তারা এরই মধ্যে তিনজনকে ধরেছেন। আমি মামলা করব। ডিএমপি কমিশনার, ডিবি প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার কথা হয়েছে। সবাই আমাকে আশ্বস্ত করেছেন।
ডরিন বলেন, আমার সাথে বাবার সর্বশেষ ভিডিওকলে কথা হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন আম্মু আমি ইন্ডিয়াতে যাচ্ছি। দু-একদিনের মধ্যে চলে আসব। তোমার দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। আমি ফিরে এসে তোমাকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো, তুমি যেও না। ডাক্তার ফোন করলে বলবে বাবা ইন্ডিয়াতে গেছে, ফিরে এলে যাবো। তুমি থাক, আমি আসছি। তারপর আর বাবার সাথে কথা হয়নি। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কাউকে সন্দেহ করছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, আমি আগে দেখতে চাই কারা এ কাজ করেছে। তারপর আমি আমার সন্দেহের কথা বলব। বাবার সাথে কারো শত্রুতা ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি জানি না। এ রকম কিছু এখনো আমি জানতে পারিনি। যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে, তাদের আগে ধরা হোক। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে। আমি যদি জানতাম, তাহলে তো ডিবি পুলিশকে বলেই যেতাম। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার কথা হয়েছে। তিনি বলেছেন চিন্তা করো না। আমি তার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
এর আগে, বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ভারত গিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার দুই দিন পর থেকে তার আর কোনো খোঁজখবর আমরা পাইনি। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে তার মেয়ে আমাদের বিষয়টি জানান। বিষয়টি আমলে নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ ভারতীয় পুলিশের সাথে যোগাযোগ রাখছিল। সবশেষ ভারতীয় পুলিশের মাধ্যমে আমরা আজ (বুধবার) নিশ্চিত হয়েছি যে, আনোয়ারুল আজিম খুন হয়েছেন। ভারতীয় পুলিশের দেয়া তথ্য এবং আমাদের সন্দেহ দুটো মিলিয়ে এখন পর্যন্ত আমরা তিনজনকে আটক করেছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আনারের হত্যার সাথে জড়িত তিনজনই বাংলাদেশী। এখন পর্যন্ত ভারতের কেউ জড়িত থাকার খবর আমরা পাইনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ঝিনাইদহের ওই এলাকাটি অত্যন্ত সন্ত্রাসপ্রবণ। পুলিশ এটি নিয়ে কাজ করছে। শিগগিরই খুনের মোটিভ কী ছিল সেটি জানাবো। আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে আনোয়ারুল কলকাতার নিউ টাউনে খুন হয়েছেন। একটি বাসায় তাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, লাশ এখনো আমাদের হাতে আসেনি। তদন্তের স্বার্থে আমরা আর কোনো তথ্য প্রকাশ করতে চাইছি না।
লাশ পায়নি কলকাতা পুলিশ : গোয়েন্দা তথ্যে আনোয়ারুল আজিম খুন হয়েছেন জানা গেলেও তার লাশ খুঁজে পায়নি ভারতীয় পুলিশ। বুধবার পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সিআইডির মহাপরিদর্শক (আইজি) অখিলেশ চতুর্বেদী স্থানীয় সাংবাদিকদের এ কথা জানান। তিনি বলেন, আনোয়ারুল আজিমকে খুন করা হয়েছে বলে আমরা গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছি। কিন্তু আমরা তদন্তে এসে শনাক্ত করা ফ্ল্যাটে তার লাশ পাইনি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের এমপি ব্যক্তিগত সফরে এখানে এসেছিলেন। তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। ১৮ মে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটে একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন তার পরিচিত গোপাল বিশ্বাস। এই অভিযোগের ভিত্তিতেই আমরা তদন্ত করতে শুরু করি। ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট থেকে একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করা হয়। আমরা ২০ মে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই মামলাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার জন্য নির্দেশ পাই। এখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে দেখার নির্দেশ দেয়। পরে ২২ তারিখে আমরা গোয়েন্দা তথ্য পাই যে, হয়তো তাকে খুন করা হয়েছে। তারপর আমরা কেস রেজিস্ট্রার করেছি। আর এই কেসের তদন্তভার পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি নিয়েছে। তারপর আমাদের পুলিশ সেই ফ্ল্যাটের অবস্থান শনাক্ত করেছে, যেখানে তাকে সর্বশেষ দেখা গেছে।
অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত যে তথ্য পেয়েছি তাতে সংসদ সদস্য আনোয়ারুল ১২ মে কলকাতায় এসেছেন। পরে এখানে এসে একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে ওঠেন। তবে এখানে এখন পর্যন্ত কোনো লাশ পাওয়া যায়নি। তিনি এর আগে এসেছিলেন কি না সেটি পরিষ্কার নয়। এই বিষয়ে আরো কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে সেসব তথ্য প্রকাশ করা যাচ্ছে না। আজিমের লাশ খণ্ড করা হয়েছে বলে বাংলাদেশের পুলিশ জানিয়েছে, এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, আমরা মাত্রই তদন্তভার গ্রহণ করেছি। আমাদের এসএসএল আছে, ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যুরো আছে, ফটোগ্রাফি টিম আছে, তারা সবগুলো দেখছে। এই বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া গেলে তা জানিয়ে দেয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে কি ঢাকা থেকে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশ পুলিশ, অপর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, এই বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। ওই তিন ব্যক্তির সাথে কী সম্পর্ক ছিল, প্রশ্নের জবাবে অখিলেশ বলেন, আমাদের তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে।
অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, বাংলাদেশের ওই সংসদ সদস্য সন্দীপ রায় নামের এক ব্যক্তির ফ্ল্যাটে উঠেছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আবগারি দফতরে চাকরি করেন। তিনি ফ্ল্যাট ভাড়া কাকে দিয়েছিলেন, জানতে চাইলে সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা আখতারুজ্জামান নামের এক ব্যক্তিকে। এই আক্তারুজ্জামানের সাথে বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই বিষয়ে আর বিস্তারিত বলা যাবে না। তদন্তের বিষয় আছে।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ারুল আজিম গত ১২ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে কলকাতায় তার পারিবারিক বন্ধু ও কলকাতার স্বর্ণব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের সাথে দেখা করতে যান। পরের দিন, ১৩ মে চিকিৎসক দেখাতে হবে জানিয়ে বেলা ১টা ৪১ মিনিটে গোপালের বাড়ি থেকে বের হন আনোয়ারুল। সন্ধ্যায় ফিরবেন বলেও জানান তিনি। পরে বিধান পার্কের কাছে কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন তিনি।
চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় আজিম তার বন্ধু গোপালকে জানান, দিল্লি যাচ্ছেন এবং সেখানে পৌঁছে তাকে ফোন করবেন। পরে তার সাথে ভিআইপিরা আছেন জানিয়ে বন্ধু গোপালকে ফোন না দেয়ার জন্য বলেছিলেন। গত ১৫ মে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তায় এমপি আনোয়ারুল গোপালকে বলেন, তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন এবং ভিআইপিদের সাথে আছেন। তাকে ফোন করার দরকার নেই। একই বার্তা পাঠিয়ে দেন বাংলাদেশে তার ব্যক্তিগত সহকারী রউফের কাছেও। ১৭ মে আনোয়ারুলের পরিবার তার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে গোপালকে ফোন করেন। ওই সময় তারা গোপালকে বলেন, তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা। পরিবারের পক্ষ থেকে ওই দিনই ঢাকায় থানায় অভিযোগ করা হয়। এরপর থেকে এমপি আনোয়ারুলের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা : ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীমকে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় এই মামলা করেন।
মামলা হওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার রোবায়েত জামান। মামলাটি ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তদন্ত করছে বলে জানান তিনি।
মামলায় মুমতারিন উল্লেখ করেন, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় বাবাকে খোঁজ করতে থাকেন। সন্ধান না পেয়ে ভারতে অবস্থানরত তার বাবার বন্ধু শ্রী গোপাল বিশ্বাস ভারতের বরানগর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এর পরও বাবাকে খোঁজাখুঁজি অব্যাহত রাখেন। পরে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারেন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তার বাবাকে অপহরণ করেছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা