১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

উত্তেজনা বাড়তে পারে মধ্যপ্রাচ্যে

-


ইরানের প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। কেননা এ অঞ্চলে ইরানের বেশ গভীর ও বিস্তৃত প্রভাব রয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সংগ্রামরত সংগঠনগুলোকে সমর্থন দিয়ে আসছে ইরান। যার ফলে এই দেশগুলো পাল্টা শক্তি প্রদর্শন করতে পারে এবং ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের কট্টর শত্রু যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইলের হামলা প্রতিহত করতে পারে।
গত মাসে সিরিয়ায় ইরানি কন্স্যুলেটে বিমান হামলায় দুই ইরানি জেনারেল ও পাঁচ কর্মকর্তা নিহত হওয়ার জবাবে রাইসি ও সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নেতৃত্বে ইসরাইলে ইরানের শত শত ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা তুঙ্গে উঠে। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জর্দান এবং অন্যদের সহায়তায় ইসরাইল প্রায় সব হামলা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু জবাবে ইরানের ইস্পাহান শহরে একটি বিমান প্রতিরক্ষা রাডার সিস্টেমের ওপর হামলা চালায় ইসরাইল। এতে কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও এই হামলা একটি সতর্ক বার্তাই ছিল বলা যায়।
বছরের পর বছর ধরে দুই পক্ষের মধ্যে গোপন অভিযান ও সাইবার হামলার মতো আড়ালে যুদ্ধ চললেও গত এপ্রিলে গোলাগুলি ছিল তাদের প্রথম সরাসরি সামরিক সঙ্ঘাত। ইসরাইল ও হামাসের মধ্যকার যুদ্ধে ইরানের অন্যান্য মিত্ররাও জড়িয়ে পড়েছে। যার ফলে হামলা-পাল্টা হামলা বড় এক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যার কারণে রোববারের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার মতো অপ্রত্যাশিত মারাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে।
ইসরাইলের সাথে ইরানের মধ্যে দীর্ঘদিনের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। তেহরানের পরমাণু কর্মসূচি, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ইসরাইলকে ধ্বংসের শপথ নেয়া সংগঠনগুলোর প্রতি সমর্থনের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ইরানকে সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখে আসছে ইসরাইল। অন্য দিকে ইরানও নিজেকে ইসরাইলি শাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দেখে এবং দেশটির শীর্ষ নেতারা বছরের পর বছর ধরে ইসরাইলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।
কট্টরপন্থী হিসেবে পরিচিত রাইসি, যিনি খামেনির সম্ভাব্য উত্তরসূরি ছিলেন তিনি গত মাসে ইসরাইলের সমালোচনা করে বলেন, ‘ইহুদিবাদী ইসরাইল ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। তিনি আরো বলেন, ‘প্রথমত দখলদারদের বিতাড়িত করতে হবে, দ্বিতীয়ত, তারা যে ক্ষতি করেছে তার মূল্য আদায় করতে হবে এবং তৃতীয়ত, অত্যাচারী ও দখলদারকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

ধারণা করা হয়, ইরানের উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে কয়েক বছর ধরে ইসরাইল অসংখ্য হামলা চালিয়েছে। তবে রোববারের হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনায় ইসরাইলের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং ইসরাইলি কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
ইরান বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা দিয়েছে। হামাসের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলা যা গাজা যুদ্ধের সূত্রপাতের কারণ, এটির সাথে হামলায় ইরান সরাসরি জড়িত ছিল এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অন্য দিকে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইরানের নেতারা ফিলিস্তিনিদের সাথে সংহতি প্রকাশ করে আসছেন। এ অঞ্চলে তাদের মিত্ররা অনেক দূর এগিয়েছে।
গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরাইলের সাথে সঙ্ঘাত চালিয়ে যাচ্ছে। এখনো ইসরাইল-লেবানন সীমান্তে প্রায় প্রতিদিনই দুই পক্ষের মধ্যে হামলা চলছে, যার ফলে উভয় পক্ষের হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই সঙ্ঘাত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়নি। ইরানের আরেক মিত্র ইয়েমেনের হাউছি বিদ্রোহীরা ইসরাইলকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে বারবার আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, ইরান বিশ্বের অন্য অঞ্চলগুলোতেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। ইসরাইল ও পশ্চিমা দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহ করে আসছে যে, শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচির আড়ালে ইরান পরমাণু অস্ত্র নির্মাণ করছে। বর্তমানে ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা ৯০ শতাংশের কাছাকাছি অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহারযোগ্য। জাতিসঙ্ঘের পরমাণু সংস্থার ক্যামেরা ও পরিদর্শকদের নিষিদ্ধ করেছে ইরান। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বরাবরই শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে বলে জানালেও যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যরা মনে করে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তাদের সক্রিয় পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ছিল। ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হলেও এ ধরনের অস্ত্র থাকার কথা কখনোই স্বীকার করেনি ইসরাইল। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর রাশিয়ার প্রধান মিত্র হিসেবেও আবির্ভূত হয়েছে ইরান। ইউক্রেনের শহরগুলোতে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো বিস্ফোরক ড্রোনগুলো ইরানের সরবরাহ করা এমন অভিযোগ এসেছে।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে (এপি) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে রাইসি এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিলেন, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইরান এ ধরনের অস্ত্র সরবরাহ করেনি। ইরানি কর্মকর্তারা ড্রোন সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য করলেও মার্কিন ও ইউরোপীয় কর্মকর্তারা বলছেন যে ইউক্রেন যুদ্ধে ড্রোনের ব্যাপক ব্যবহারই বলে দেয় যুদ্ধ শুরুর পর এই অস্ত্রের সরবরাহও বেড়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement