তহবিল ব্যয় বৃদ্ধিতে কমছে বিনিয়োগ
- আশরাফুল ইসলাম
- ১৯ মে ২০২৪, ০০:০০
- কলমানি সুদহার বেড়েছে ৫৪ শতাংশ
- নীতি সুদহার বেড়েছে ৪১ শতাংশ
- পণ্য আমদানি ১ বছরে অর্ধেকে নেমে এসেছে
এক বছরে প্রতি ডলারে টাকার মান কমেছে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ। ব্যাংকগুলোর আপৎকালীন ব্যয় মেটাতে কলমানি মার্কেট থেকে ধার করতে সুদহার বেড়েছে ৫৪ বেসিস পয়েন্ট। পাশাপাশি নীতি সুদহার (রেপো) বেড়েছে ৪১ শতাংশ। আর এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংক ঋণের সুদহারে। এক দিকে ব্যাংকের তহবিল ব্যয় বেড়ে গেছে। অপর দিকে বেড়েছে ব্যাংক ঋণের সুদহার। সবমিলেই বেড়ে যাচ্ছে ব্যবসা ব্যয়। ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, যার জন্য বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের দাম। আর এ কারণে আমদানি ব্যয় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আমদানি ব্যয় অর্ধেকে নেমে আসার অর্থই হলো ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্মকাণ্ড আর আগের মতো চলছে না। কাঁচামালের অভাবে অনেক শিল্পের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। এতে কমে যাচ্ছে কর্মসংস্থান।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলোর টাকার সঙ্কট দেখা দিলে এক ব্যাংক আরেক ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে থাকে। এটাকে ব্যাংকিং ভাষায় কলমানি বা আন্তঃব্যাংক লেনদেন বলে। এ আন্তঃব্যাংক লেনদেন থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের ১৫ মে এ কলমানি সুদহার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে এ সুদহার ৫৪ দশমিক ২৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ব্যাংকেরই তহবিল সঙ্কট চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিনিয়তই ধার করে চলছে কিছু কিছু ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনে ২৬ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ধার দিয়েছে ব্যাংকগুলোকে। আর এ কারণেই ব্যাংকগুলোর হাতে উদ্বৃত্ত কম থাকায় কলমানি মার্কেটে সুদহার বেড়ে গেছে। এখন বেশি সুদে তহবিল সংগ্রহ করে বেশি সুদেই বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে বিনিয়োগ ব্যয়।
অপর দিকে কলমানি মার্কেট থেকে পর্যাপ্ত অর্থ ব্যাংকগুলো ধার করতে না পারলে বা সুদহার বেড়ে গেলে কম ব্যয়ের আশায় ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করে। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, রেপোর হারও প্রতিনিয়তই বাড়িয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে ১০০ টাকা ধার নিতে ব্যাংকগুলোর ৬ টাকা ১০ পয়সা ব্যয় হতো। অর্থাৎ রেপোর হার ছিল ৬.১০ শতাংশ। কিন্তু এই রেপোর হার গত এক বছরে কয়েক দফা বাড়িয়ে সর্বশেষ তা ৮ দশমিক ৬০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, শুধু নীতি সুদহারই এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৪১ বেসিস পয়েন্ট। রেপোর হার বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেড়ে গেছে। আর এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে ব্যাংক ঋণের সুদহারের ওপর।
এক দিকে কলমানি মার্কেট ও নীতি সুদহার বেড়েছে, পাশাপাশি বেড়েছে ডলারের দাম। গত বছরের ১৫ মে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত ডলারের দাম ছিল ১০৭ টাকা ৮৩ পয়সা। চলতি মে মাসের ১৫ তারিখে তা লেনদেন হয়েছে ১১৭ টাকা ৫৩ পয়সা। গত এক বছরে ডলারের দর বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ। যদিও এ দরে কোথাও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকভেদে ডলারের প্রকৃত দর ১২৫ টাকা থেকে ১২৯ টাকায় লেনদেন হচ্ছে করপোরেট ডিলিংয়ের মাধ্যমে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেড়ে গেছে। ঋণ পাওয়ার শর্ত বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের পরামর্শে এক লাফে ডলারের দাম বাড়িয়েছে ৭ টাকা। ১১০ টাকা থেকে ক্রলিং পেগ নামক এক নতুন পদ্ধতিতে ডলারের মধ্যবর্তি দর নির্ধারণ করেছে ১১৭ টাকা। এ দর থেকে ১ টাকা বেশি বা কম দামে লেনদেন করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ব্যাংক রেমিট্যান্স আহরণ করতে প্রতি ডলার ১২২ টাকা থেকে ১২৩ টাকা ব্যয় করছে। ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক আমদানি ব্যয়ও বেড়ে গেছে।
এ দিকে কলমানি মার্কেট ও নীতি সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে গেছে। ব্যাংক ঋণের সুদহার আগে বেধে দেয়া হয়েছিল। তখন সুদহার ছিল ৯ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আইএমএফের পরামর্শে সুদহার বাজারভিত্তিক করায় তা এখন ১৫ শতাংশের কাছাকাছি চলে গেছে। গত সপ্তাহের শেষ দিকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। একজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, এক দিকে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। সেই সাথে বেড়েছে ব্যাংক ঋণের সুদহার। সবমিলেই বেড়ে গেছে ব্যবসা ব্যয়। অনেক প্রতিষ্ঠানই কাঁচামালের অভাবে শিল্পের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। এতে কমে যাচ্ছে কর্মসংস্থান।
এ দিকে ডলারের সঙ্কটে ব্যাংকগুলো আর আগের মতো বৈদেশিক বাণিজ্য চালাতে পারছে না। ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। এতে আমদানি ব্যয় অর্ধেকে নেমে গেছে। বছর দুয়েক আগেও পণ্য আমদানি ব্যয় ৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। এখন তা ৪ বিলিয়নের ঘরে নেমে গেছে। এর মধ্যে জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে ২৫ শতাংশ। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ২৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
সামগ্রিক আমদানি কমে যাওয়ায় ও ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা বাণিজ্য সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান হওয়ার কথা সেখানে কর্মসংস্থান না বেড়ে বরং কমে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবেই বছরের প্রথম প্রান্তিকে বেকার হয়েছে আরো ২ লাখ ৪০ হাজার। ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকের চেয়ে এ বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে নারী ও পুরুষ উভয় জনসংখ্যার মধ্যেই বেকারত্ব বেড়েছে। সামগ্রিক সময়ের বিবিএসের জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, সার্বিক বেকারত্ব হার বেড়ে ৩ দশমিক ৫১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দেশে বেকার সংখ্যা এখন ২৫ লাখ ৯০ হাজার জন, যা ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার। এই হিসাবে বেকার সংখ্যা বেড়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার। বেকারত্বের এই হিসাবে করা হয় সপ্তাহে ৩৪ ঘণ্টা কাজ করলে তাকে অবেকার হিসাব করে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ব্যবসা ব্যয় কমাতে না পারলে বেকারত্বের হার আরো বেড়ে যাবে। এ পরিস্থিতি সরকারের নীতিসহায়তা আরো বাড়ানো প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা