১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ফিলিস্তিনিদের রাফাহ ছাড়ার নির্দেশ ইসরাইলের

-

- হামাসের রকেট হামলায় ৪ ইসরাইলি সেনা নিহত
- যুক্তরাষ্ট্রে আন্দোলনকারীদের তাঁবু ভেঙে দিল পুলিশ
- ইসরাইলে অস্ত্র পাঠানো স্থগিত বাইডেন প্রশাসনের
- রাফাহতে আক্রমণ বিপর্যয়কর হবে : জাতিসঙ্ঘ

অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহ’র একাংশ খালি করে দিতে সেখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে ইসরাইল। গতকাল সোমবার ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর নির্দেশের পর রাফার পূর্বাঞ্চল থেকে ইতোমধ্যে লোকজন সরে যেতে শুরু করেছেন। এই নির্দেশ ‘সীমিত পরিসরের’ অভিযানের একটি স্থল আক্রমণের প্রস্তুতির অংশ, গণমাধ্যমে এমন খবর প্রকাশিত হলেও তাৎক্ষণিকভাবে ইসরাইলি বাহিনী তা নিশ্চিত করেনি। খবর: রয়টার্স, আলজাজিরা ও সিএনএন।
গাজায় সাত মাস ধরে অবিরাম নির্মম হামলা চালানোর পর ইসরাইল বলছে, ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের কয়েক হাজার যোদ্ধা রাফাহতে আত্মগোপন করে আছে, তাই শহরটি দখল করা ছাড়া বিজয় অসম্ভব। কিন্তু গাজার ১০ লাখেরও বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি রাফাহতে আশ্রয় নিয়ে আছে। সেখানে কোনো সামরিক অভিযান হলে তাতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে উদ্বিগ্ন পশ্চিমা শক্তিগুলো ও প্রতিবেশী মিসর।
মূলত রাফাহের পূর্বাংশে থাকা ফিলিস্তিনিদের নিকটবর্তী একটি ‘মানবিক এলাকায়’ চলে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী। তাদের এ আহ্বান রাফায় স্থল আক্রমণের আগে বেসামরিকদের সরিয়ে নেয়ার ‘শুরু হতে পারে’ বলে জানিয়েছে রয়টার্স। গতকাল এক বিবৃতিতে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, ‘বেসামরিকদের ধীরে ধীরে ওই নির্দিষ্ট এলাকায় যেতে উৎসাহিত করতে’ পোস্টার, ক্ষুদে বার্তা, ফোন কল এবং গণমাধ্যমে ঘোষণা ব্যবহার করবে তারা।

তবে তারা রাফার বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার জন্য কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়নি বলে জানিয়েছে। ‘সীমিত পরিসরের’ অভিযানের জন্য রাফার এক লাখ বাসিন্দাকে সরিয়ে নিতে হবে বলে হিসাব করেছে বাহিনীটি। এর আগে ইসরাইলি সম্প্রচারমাধ্যম আর্মি রেডিও জানিয়েছে, রাফায় হামলা শুরুর আগে ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের সরিয়ে নেয়া শুরু করেছে ইসরাইলের সশস্ত্র বাহিনী। কিন্তু দেশটির সামরিক বাহিনী এ তথ্য নিশ্চিত করেনি। আর্মি রেডিও জানিয়েছে, লোকজনকে সরিয়ে রাফার প্রান্তীয় কিছু এলাকায় নেয়া হবে, সেখান থেকে তাদের খান ইউনুস ও আল মুওয়াসির নিকটবর্তী তাঁবুর শহরে নিয়ে যাওয়া হবে।
৪ ইসরাইলি সেনা নিহত : ফিলিস্তিনের ছিটমহল গাজার রাফাহ শহরের নিকটবর্তী কেরেম শালম ক্রসিংয়ে এক রকেট হামলায় চার ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছে। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের সশস্ত্র শাখা এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় রাফাহতে ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে অন্তত ১৯ জন নিহত হয়েছে বলে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী জানায়, রাফাহ থেকে ওই ক্রসিং এলাকা লক্ষ্য করে ১০টি রকেট ছোড়া হয়, তারপর থেকে ওই ক্রসিং দিয়ে গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাকের প্রবেশ বন্ধ আছে। অন্য ক্রসিংগুলো খোলা আছে। হামাসের সশস্ত্র শাখা জানিয়েছে, ক্রসিংয়ের পাশে ইসরাইলের সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে রকেট ছুড়েছে তারা। কিন্তু তারা কোথা থেকে রকেটগুলো ছুড়েছে তা নিশ্চিত করেনি। হামাসের গণমাধ্যম ওই সশস্ত্র শাখার ঘনিষ্ঠ এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানিয়েছে, বাণিজ্যিক ক্রসিংটি রকেট হামলার লক্ষ্যস্থল ছিল না। ফিলিস্তিনি চিকিৎসা কর্মীরা জানিয়েছেন, হামাসের ওই হামলার কিছুক্ষণের মধ্যেই রাফার একটি বাড়িতে বিমান হামলা চালায় ইসরাইল আর তাতে তিনজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন।

ইসরাইলবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত : গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে গত রোববার সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভকারীদের তাঁবুগুলো ভেঙে দিয়েছে পুলিশ। তবে এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁবু ভেঙে দেয়া এবং কমপক্ষে ২৫ জন ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করার এক দিনের মাথায় এমন ঘটনা ঘটল। রোববার স্থানীয় সময় ভোর পাঁচটার দিকে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢোকে। এরপর ক্যাম্পাসে পুলিশের সাথে যৌথভাবে বিক্ষোভকারীদের তাঁবুগুলো ভেঙে ফেলে তারা। পুলিশ বলেছে, বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে সেখান থেকে সরে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান বিক্ষোভে বিক্ষোভকারীরা দাবি জানাচ্ছে যেন কর্তৃপক্ষ ইসরাইলের সাথে আর্থিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের বছরটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান বিক্ষোভের ঘটনা রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। পুলিশ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে এখন পর্যন্ত ২ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেফতার করেছে। রাজনৈতিক চাপের মুখে গত বৃহস্পতিবার বাইডেন ক্যাম্পাসের বিক্ষোভ নিয়ে নীরবতা ভেঙেছেন। বলেছেন, মার্কিন নাগরিকদের বিক্ষোভ করার অধিকার আছে, তবে সহিংসতা ছড়ানোর অধিকার নেই। ইতোমধ্যে বিক্ষোভ ঠেকাতে নিউ ইয়র্ক সিটির কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ ডাকা হয়েছে।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, রোববার অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২০০ জন ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারী বিক্ষোভ করছেন। পুলিশের মোতায়েন করা ড্রোন বিক্ষোভকারীদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ছিল। বক্তারা বিক্ষোভকারীদের শান্ত থাকার এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষে না জড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। অস্টিনে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভের আয়োজন করেছে প্যালেস্টাইন সলিডারিটি কমিটি নামের একটি সংগঠন। অ্যাডাম নামে এর এক সংগঠক আলজাজিরাকে বলেন, ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারছে যে আমেরিকান শিক্ষার্থীরা ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে। তিনি বলেন, ‘ফিলিস্তিনিদের রক্তের বিনিময়ে কোনো চুক্তি আমরা আর মেনে নেব না।’ ইরভিনে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলজাজিরার প্রতিনিধি ফিল ল্যাভেল জানান, সেখানকার পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত শান্ত। বিক্ষোভকারী এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে আলোচনা চলছে। এদিকে পুলিশ বলেছে, সপ্তাহান্তে নিউ ইয়র্ক এলাকায় ইহুদি উপাসনালয়গুলোতে অন্তত চারটি বোমা হামলার হুমকি এসেছে। তবে এসব হুমকির কোনোটিই বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রমাণ মেলেনি। ইসরাইলে অস্ত্র পাঠানো স্থগিত : যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি গোলাবারুদের একটি চালান ইসরাইলে পাঠানো থামিয়ে দিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন। বাইডেন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে অবগত একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে বলে জানিয়েছে সংবাদ মাধ্যম সিএনএন। তবে বাইডেন প্রশাসন কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল, তা প্রকাশ করেনি সূত্র। সূত্রটি অবশ্য বলেছে, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার রাফায় সম্ভাব্য ইসরাইলি সামরিক অভিযানের সাথে বাইডেন প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তের যোগসূত্র নেই। এ ছাড়া এ সিদ্ধান্ত ইসরাইলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য চালান পাঠানোর বিষয়টিকে প্রভাবিত করবে না।
চালানটির বিষয়ে জানতে চাইলে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের এক মুখপাত্র ইসরাইলকে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া চলমান নিরাপত্তা সহায়তার কথা উল্লেখ করেন। মুখপাত্র বলেন, গত ৭ অক্টোবরের হামলার পর থেকে ইসরাইলের জন্য নিরাপত্তা সহায়তা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরাইলকে জরুরি সহায়তা দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সর্ববৃহৎ সম্পূরক বরাদ্দ পাস করেছে।

রাফাহতে আক্রমণ বিপর্যয়কর হবে : রাফাহতে ইসরাইলের হামলা ‘আসন্ন’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট। জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) মুখপাত্র জোনাথন ফাওলার গতকাল সোমবার রাফাহতে পরিকল্পিত ইসরাইলি অভিযানের আগে সেখানে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়ার আদেশ নিয়ে আলজাজিরার সাথে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে রয়েছি যেখানে রাফাহতে ইসরাইলি বাহিনীর যে কোনো বড় আকারের অগ্রগতির অর্থ- আরো দুর্ভোগ, আরো মৃত্যু। রাফাহর জনসংখ্যার জন্য পরিণতি হবে ধ্বংসাত্মক।
যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা অব্যাহত : ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ নিয়ে দোহায় গতকাল সোমবার আবারো আলোচনা শুরুর কথা রয়েছে। যদিও যুদ্ধ বন্ধে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে মতভেদ রয়ে গেছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু রোববার বলেছেন, যুদ্ধ বন্ধের দাবির কাছে সমর্পণ মানে পরাজয় মেনে নেয়া। এদিকে কাতারভিত্তিক হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আলোচনায় যড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement