লন্ডনের মেয়র পদে কিভাবে সম্ভব হলো সাদিক খানের এই রেকর্ড জয়
- সাঈদ চৌধুরী লন্ডন থেকে
- ০৬ মে ২০২৪, ০০:০৫
সাদিক খান লন্ডনের মেয়র হিসেবে ঐতিহাসিক জয় পেয়েছেন। টানা তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়ে তিনি ও তার দল যেমন আনন্দিত, তেমনি দলের বাইরের বিপুলসংখ্যক শুভাকক্সক্ষী উল্লসিত। প্রথম কোনো রাজনৈতিক নেতা এবং প্রথম কোনো মুসলিম ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনের মেয়র পদে পর পর তৃতীয়বার বিজয়ী হয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। বিজয়ী ভাষণে সাদিক খান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাককে জাতীয় নির্বাচন ঘোষণার আহ্বান জানান।
কিভাবে সম্ভব হলো তার এই ঐতিহাসিক বিজয়?
এক বছর আগে সাদিক খান বিশ্ব পরিবেশের ওপর ফোকাস করে লন্ডনের বাতাস পরিষ্কার করার জন্য একটি গ্রন্থ রচনা করেন। নিউইয়র্কে গত বছরের জাতিসঙ্ঘের জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিয়ে দাবি করেছিলেন, তিনি মানুষকে ‘সচেতন’ করছেন এবং ২০৩০ সালের মধ্যে জিরো কার্বন নির্গমনের যাত্রায় সকলকে সাথে নিয়ে যাচ্ছেন। তার সেই গ্রন্থ এবং প্রতিশ্রুতি মেয়র নির্বাচনের মাঠে তাকে কিছুটা হলেও এগিয়ে রেখেছিল।
এ ছাড়া অতীতের মতো এবারো সাদিক খানের বিরোধীরা তার মুসলিম পরিচয়কে সামনে এনে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। এমনকি তার সাথে উগ্রপন্থীদের যোগাযোগ আছে বলেও নানা রকম বিদ্বেষী প্রচারণা চালায় বিরোধীরা। এতে ক্ষতির চেয়ে তার লাভ হয়েছে। সর্বস্তরের মুসলমানদের ভোট পেয়েছেন তিনি। অন্য দিকে ফিলিস্তিন ইস্যুতে লেবার দলের প্রধান স্যার কেয়ার স্টারমারের বিরোধী মনোভাব পরিলক্ষিত হলেও সাদিক খান এই ইস্যুতে বেশ যোগ্যতার সাথে জনসমর্থন আদায় করেছেন।
ফলাফল ঘোষণার পর পূর্ব লন্ডনের সিটি হলে দেয়া বিজয় ভাষণে সাদিক খান বলেন, আমি এই নগরীকে প্রাণের চেয়ে ভালোবাসি, যার সেবা করতে পারা আমার জন্য দারুণ সম্মানের। নগরবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি সকলকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। গত কয়েক মাস আমাদের কঠিন সময় গেছে। আমরা অবিরাম নেতিবাচক প্রচারণার মুখোমুখি হয়েছি। তবে লন্ডনের বাসিন্দারা আজ ভয়ের পরিবর্তে আশাকে বেছে নিয়েছেন। তারা বিভাজনের পরিবর্তে ঐক্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
সাদিক খান দৃঢ়তার সাথে বলেছেন, আজ এই নগরীর ভবিষ্যৎকে আরো উজ্জ্বল করার পথে এগিয়ে চলার দিন। তাই তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মেট্রোপলিটন পুলিশে সংস্কার করা এবং লন্ডনকে আরো নিরাপদ করা। একটি পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও নিরাপদ রাজধানীর প্রত্যাশা করেন তিনি। অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে মি. খান এই দশকের শেষ নাগাদ ৪০ হাজার নতুন কাউন্সিল বাড়ি নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাদিক খান ২০১৬ সালে প্রথমবার লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হন। ইউরোপের দেশগুলোতে মুসলমানদের নিয়ে বিতর্ক যখন তুঙ্গে, সন্ত্রাসবাদ ও ইসলামকে এক করে যখন সর্বত্র হইচই চলছে- তখন ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র লন্ডনের রাজধানীতে একজন মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হয়ে বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগিয়ে ছিলেন। ২০১৮ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় জায়গা করে নেন তিনি।
কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী জ্যাক গোল্ডস্মিথের চেয়ে সাদিক খান প্রায় ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি লাভ করেন ১৩ লাখ ১০ হাজার ১৪৩ ভোট আর গোল্ডস্মিথ পেয়েছিলেন ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৬১৪ ভোট। লন্ডনের সাবেক মেয়র পরবর্তীতে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কনজারভেটিভ দলের নেতা বরিস জনসনের হাত থেকে মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
২০২১ সালে দ্বিতীয় দফায় লন্ডনের মেয়র নির্বাচিত হন সাদিক খান। তখন কনজারভেটিভ পার্টির সাউন বেইলিকে হারিয়েছিলেন। প্রথম দফার ভোটে দুইজনের কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফার ভোট গ্রহণ হয়। সেখানে ৫৫.০২ শতাংশ পপুলার ভোট পেয়েছেন তিনি। তখনো তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছিল।
১৯৯৪ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে সাদিক খান লেবার পার্টির হয়ে লন্ডনের ওয়ান্ডসওর্থ বারার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে দক্ষিণ লন্ডনের টুটিং আসন থেকে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়ে চমক সৃষ্টি করেন। ২০০৮ সালে গর্ডন ব্রাউন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পার্লামেন্টারি আন্ডার সেক্রেটারি এবং পরে যোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালে লেবার পার্টি বিরোধী দলে গেলে সাদিক খান ছায়া মন্ত্রিসভায় বিচার-বিষয়ক ছায়া মন্ত্রী, ছায়া অর্থমন্ত্রী ও লন্ডন-বিষয়ক ছায়া মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালে লন্ডনের মেয়র পদে নির্বাচনে জন্য পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগ করেন। পর পর তিনবার মেয়র হিসেবে বিজয়ী হয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
রাজনীতির পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতিও আগ্রহ রয়েছে সাদিক খানের। তার পছন্দের খেলা ফুটবল, ক্রিকেট ও বক্সিং। ২০১৪ সালে লন্ডন ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
সাদিক খানের জন্মের কিছুদিন আগে ১৯৭০ সালে তার বাবা আমানুল্লাহ খান এবং মা সেহেরুন খান পাকিস্তান থেকে লন্ডনে আসেন। সাদিক খান তাদের আট ছেলেমেয়ের মধ্যে পঞ্চম। তারা সাত ভাই ও এক বোন।
ইউনিভার্সিটি অব নর্থ লন্ডন থেকে আইন বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন সাদিক খান। ১৯৯৪ সালে একটি আইন সংস্থায় মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে যোগ দেন। ওই বছরই তার স্ত্রী সাদিয়া আহমদের সাথে পরিচিত হয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই সন্তান রয়েছে।
নির্বাচনে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভদের ভরাডুবি : নির্বাচনে মোট ছয়টি দল অংশগ্রহণ করলেও বৃহৎ দু’টি রাজনৈতিক দল- ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টিই ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে গত চার দশকের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখে ঋষি সুনাকের ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টি। এমনকি তৃতীয় অবস্থানে থেকে রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিকের কাছে ভরাডুবি হয়েছে কনজারভেটিভের। ইংল্যান্ডের সরাসরি নির্বাচিত ১১টি মেয়র আসনের মধ্যে ১০টি আসন হারিয়েছে কনজারভেটিভ। ১০টি আসনে মেয়র পদে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছে কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি। তৃতীয় অবস্থানে থাকা দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কাছে হার মেনেছে কনজারভেটিভ, সুনাকের দলকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থান দখল করে নিয়েছে লিবডেম। এ খবর পাওয়া পর্যন্ত এক হাজার ১৪০টি কাউন্সিলর পদে জয় পেয়েছে লেবার। লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পেয়েছে ৫২১টি, কনজারভেটিভ পেয়েছে ৫১৩টি , ইন্ডিপেন্ডেন্ট পেয়েছে ২২৮টি , গ্রীন পার্টি ১২১টি, রেসিডেন্স অ্যাসোসিয়েশন পেয়েছে ৪৮টি।
১১টি মেয়র পদের মধ্যে, লেবার যে ১০টি এলাকায় জিতেছে- গ্রেটার লন্ডন,পূর্ব মিডল্যান্ডস, গ্রেটার ম্যানচেস্টার, লিভারপুল সিটি অঞ্চল, উত্তর পূর্ব, সালফোর্ড, সাউথ ইয়র্কশায়ার, ওয়েস্ট মিডল্যান্ডস, ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ার এবং ইয়র্ক এবং উত্তর ইয়র্কশায়ার। স্থানীয় সরকার নির্বাচন ছাড়াও ব্ল্যাকপুল সাউথ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানেও জয় পেয়েছেন লেবার পার্টির প্রার্থী ক্রিস ওয়েব। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে প্রায় সাত হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন তিনি। তিনি ভোট পেয়েছেন ১০ হাজার ৮২৫টি। অন্য দিকে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির ডেভিড জোনস পেয়েছেন মাত্র তিন হাজার ২১৮ ভোট। এ ছাড়া লন্ডন অ্যাসেম্বলির ২৫ জন সদস্য এবং ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ৩৭ জন পুলিশ ও অপরাধ কমিশনার নির্বাচন করার জন্য ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা