রাজশাহীতে তীব্র খরায় ঝরছে আমের গুটি : ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কায় চাষিরা
- রাজশাহী ব্যুরো
- ০৪ মে ২০২৪, ০২:২৪
চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে গাছে আম কম এসেছে। টানা তাবদাহ, অনাবৃষ্টি ও পোকার উপদ্রবে গাছ থেকে ঝরে পড়ছে আমের গুটি। যথেষ্ট যতœ নেয়া সত্ত্বেও তেমন একটা সমাধান না পেয়ে ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এ অঞ্চলের চাষিরা। এরই মধ্যে অনেক বাগানের অন্তত ৫০ শতাংশের বেশি গুটি ঝরে গেছে। আম রক্ষায় অনুমোদিত মাত্রায় ওষুধ ছিটিয়েও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ ছিটাতে হচ্ছে। বৈরী এই আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন না ঘটলে গাছে পাতা ছাড়া কিছুই থাকবে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু গুটি আম ঝরে গেলেও বাকিগুলো টিকিয়ে রাখা সম্ভব হলে তেমন সঙ্কট হবে না। তাই অব্যাহত তাবদাহ ও প্রচণ্ড খরায় আমের গুটি ঝরে পড়া রোধে গাছের গোড়ায় রাতে অথবা খুব ভোরে পানি সেচ দিতে হবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর এই চারটি জেলায় চলতি মৌসুমে ৯৩ হাজার ২৬৬ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। এবার সাড়ে ১২ লাখ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে এককভাবে শুধু রাজশাহীতেই ১৯ হাজার ৬০২ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ২৪ হেক্টর বেশি। আর চলতি বছর ২ লাখ ৬০ হাজার ১৬৫ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলতি মৌসুমে বাগানের প্রায় ৭০ ভাগ গাছে মুকুল এসেছিল। সেই মুকুল গাছে থাকলে অনেক আম হতো। কিন্তু গত ২০ ও ২১ মার্চের বৃষ্টির কারণে মুকুল নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আবার তীব্র তাপদাহ ও পোকার উপদ্রবে মুকুল ঝরে যাচ্ছে। আমগাছে পানি ও কীটনাশক দিয়েও গুটি রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবে প্রতি বছরই আমের কিছু গুটি ঝরে যায়। কিন্তু চলতি মৌসুমে তীব্র তাপদাহে অনেক বাগানে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ আমের গুটি ঝরে গেছে। এতে ব্যাপক লোকসানের শঙ্কা রয়েছে।
রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের তথ্যানুযায়ী, গত ১৭ এপ্রিল থেকে রাজশাহীতে তীব্র তাবদাহ শুরু হয়েছে। সেদিন রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৮ এপ্রিল ছিল ৩৯ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯ এপ্রিল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০ এপ্রিল তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২১ এপ্রিল তাপমাত্রা ছিল ৪১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২২ এপ্রিল তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২৩ এপ্রিল তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মূলত পয়লা এপ্রিল থেকেই রাজশাহীতে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ ছিল। কিন্তু মধ্য এপ্রিল থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ তীব্র তাপপ্রবাহে রূপ নিয়েছে। টানা তাপপ্রবাহ এবার রাজশাহীতে ১৯ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। ৩০ এপ্রিল বেলা ৩টায় রাজশাহীতে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার বলছে, দিনের এই তাপমাত্রা গত ১৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
আবহাওয়া অফিসের তথ্যানুযায়ী- দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সাধারণত ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বলা হয়। এ ছাড়া ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয়। আর তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর উঠলেই তা অতি তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানেও রাজশাহীতে তীব্র তাপ্রবাহ অব্যাহত রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহীতে বেশির ভাগ আম বাগান রয়েছে বাঘা ও চারঘাট উপজেলায়। কয়েক বছর ধরে বাঘা উপজেলার সাদি এন্টারপ্রাইজ বিদেশে আম রফতানি করছে। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আসাফুদ্দৌলা গণমাধ্যমকে জানান, ‘এবার অধিকাংশ গাছে কোনো আম নেই। গাছের কোনো পরিচর্যা করছেন না চাষিরা। ফলে যেসব গাছে কিছু আম আছে তাতেও পোকার উপদ্রব দেখা যাচ্ছে। বাগানে মাছি পোকা ও লেদা পোকানাশক বিষ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না।’
গোদাগাড়ী উপজেলার আমচাষি তৌহিদুর রহমান পারভেজ জানান, ‘টানা তাপদাহে আম শুকিয়ে কালো রং ধারণ করছে। পোকা ছিদ্র করায় আম শুকিয়ে ঝরে পড়ছে। ফলে আমের ফলন বিপর্যয়ের শঙ্কায় আছি। অনুমোদিত মাত্রার বাইরে ওষুধ ব্যবহার করিনি। শ্রমিকদের আগেই বলেছিলাম শুধু অনুমোদিত মাত্রায় ওষুধ দিয়ে পোকার আক্রমণ থেকে আম রক্ষা করা সম্ভব হবে না। তবে শেষ পর্যন্ত তা-ই হয়েছে। আমার বাগানের আম পোকায় প্রায় শেষ করে দিয়েছে।’
এদিকে রাজশাহী নগরীর বুধপাড়া, মোহনপুর, পবা ও মেহেরচণ্ডীর বেশ কিছু এলাকা ঘুরে আমের গুটি ঝরা লক্ষ্য করা গেছে। তবে কিছু গাছে গুটি শুকিয়ে পাশের আমের সঙ্গে ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ গাছের আমের গুটি মাটিতে ঝরে পড়ছে। এই এলাকার চাষিদের দাবি, ১৫ থেকে ২০ শতাংশ আমের গুটি ঝরেছে।
আম চাষি রাকিবুল ইসলাম জানান, গেল বছর বাগানের ২২টি গাছের মধ্যে ১৫টি গাছে আম এসেছিল। বাকি গাছগুলোতে নতুন পাতা ছিল। এ জন্য এ বছর আম ভালো পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু এ বছরও বাগানে আশানুরূপ ফল আসেনি। যেসব গাছে ধরেছে সেখানেও টানা গরমের কারণে গুটি ঝরে পড়ছে।
আমচাষি রোস্তম আলী জানান, বৃষ্টি না থাকায় আমের কিছু রোগ দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে আম গাছের এক ধরনের সাদা পোকা। এই পোকাগুলো থাকলে আমের ক্ষতি হচ্ছে। তবে তাপপ্রবাহের কারণে কয়েকদিন থেকে গাছের গোড়ায় পানি দিচ্ছি। কিছু আমের গুটি গাছেই শুকিয়ে গেছে। তবে বেশির ভাগ শুকিয়ে ঝরে পড়েছে।
তিনি আরো বলেন, এই মুহূর্তে গাছে কীটনাশক ¯েপ্র করলে আমের গুটির ক্ষতি হতে পারে। ফলে আরো বেশি গুটি ঝরতে পারে। তাই গুটি ঝরা রোধে বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত সেচের বিকল্প নেই। সেচ দিলে আমের গুটি ঝরা অনেকটা কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, ‘গত বছরের তুলনায় এবার এমনিতেই রাজশাহীতে আমের মুকুল কম। তার ওপর মুকুলে ফুল ফোটার সময়ে গত ২০ ও ২১ মার্চ বৃষ্টি হয়ে এ অঞ্চলের আমের অনেক মুকুল নষ্ট হয়ে গেছে। যেগুলো টিকে ছিল সেগুলো তীব্র তাপপ্রবাহে ঝরে পড়ছে। তাই ঝরে পড়া রোধে আমগাছের গোড়ায় পানি দিতে হবে। বৃষ্টিপাত না হলে আমের গুটি ঝরা কমবে না। গুটি ঝরা গাছের গোড়ায় সেচ দেওয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।’
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) শারমিন সুলতানা জানিয়েছেন, ‘অনাবৃষ্টি ও প্রচণ্ড খরায় রাজশাহীতে আমের মুকুল ঝরে পড়ছে। খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সতর্কতার সঙ্গে গাছ পরিচর্যা করা দরকার। গাছের গোড়ায় অল্প পরিমাণ পানি ও পরবর্তীতে ইউরিয়া ও পটাশ সার দিতে হবে। আমের গুটি রক্ষায় বরিক অ্যাসিডও ¯েপ্র করতে হবে। আম গাছে যে পরিমাণ মুকুল আসে তা শতভাগ থাকবে না এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তবে এ বছর মুকুল কিছুটা কম এসেছে। তা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত গাছে যে পরিমাণ মুকুল বা গুটি আছে সেগুলো বড় হলে আমের সঙ্কট হবে না বলে মনে করেন তিনি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা