মৃত্যুসনদ নিজেই তৈরি করতেন মিল্টন সমাদ্দার
প্রতারণার মামলায় ৩ দিনের রিমান্ডে- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ০৩ মে ২০২৪, ০১:৩৪
আলোচিত চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার সিটি করপোরেশনের মৃত্যুসনদ নিজেই তৈরি করতেন। এভাবে রাতের আঁধারে প্রায় ৯০০ লাশ দাফনের ভুয়া মৃত্যুসনদ নিজেই তৈরি করেছেন।
আলোচিত সেই মিল্টন সমাদ্দার এখন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে বন্দী। প্রতারণার মাধ্যমে মৃত্যুর জাল সনদ তৈরির অভিযোগে করা মামলায় তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
এর আগে বুধবার (১ মে) রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এরপর তার বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
জানা যায়, মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে প্রতারণার নানা অভিযোগ উঠে আসছে। এতে বলা হয়, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ১৬টির বেশি নম্বর এবং তিনটি ব্যাংক হিসাবে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকা জমা হয়। এর বাইরে অনেকেই তার প্রতিষ্ঠানে সরাসরি অনুদান দিয়েছেন। এই অর্থের অপব্যবহার করেন তিনি। মানবিক কাজের জন্য এ পর্যন্ত তিনি তিনটি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পেয়েছেন। এর মধ্যে মৃত্যুসনদ জাল করার অভিযোগে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে পুলিশ। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মিরপুর বিভাগের এসআই মোহাম্মদ কামাল পাশা বাদি হয়ে গতকাল (বৃহস্পতিবার) মিরপুর মডেল থানায় মামলাটি করেন।
এ ছাড়া মানব পাচার ও অবৈধভাবে আটক রাখার অভিযোগে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে আরো দুটি মামলা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, মিল্টন সমাদ্দার কোনো নিবন্ধিত চিকিৎসক নন। তার প্রতিষ্ঠানে কোনো নিবন্ধিত চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়নি। তিনি চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার সেবার নামে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে প্রতারণামূলকভাবে অর্থ উপার্জন করেন। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে মৃত্যুসনদ বানাতেন এবং নিজেই মৃত্যু সনদে চিকিৎসক সেজে স্বাক্ষর করতেন। মিল্টন সমাদ্দার ও তার ব্যবস্থাপক কিশোর বালা মানবতার সেবার নামে অজ্ঞাতনামা শিশুসহ বয়স্ক লোকদের সাথে প্রতারণা করতেন।
গতকাল মিল্টন সমাদ্দারকে কোর্টে হাজির করা হয়। শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালত তিন দিনের রিমান্ডে নেয়ার আদেশ দেন। এর আগে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর জোনাল টিম গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) এসআই মোহাম্মদ কামাল হোসেন আসামিকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন।
এ সময় মিল্টনের আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ এই জামিনের বিরোধিতা করে রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত মিল্টন সমাদ্দারের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে দুপুরের দিকে মিল্টনকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। মিরপুর মডেল থানায় দায়ের করা মামলায় তাকে আদালতে তোলে পুলিশ। এরপর তাকে ঢাকা সিএমএম আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। বিকেল সোয়া ৩টার দিকে এজলাসে তোলা হয় আসামিকে।
ভুয়া মৃত্যুসনদ নিজেই তৈরি করতেন মিল্টন : পুলিশ জানিয়েছে, মিল্টন সমাদ্দার সিটি করপোরেশনের মৃত্যুসনদ নিজেই তৈরি করতেন। এভাবে রাতের আঁধারে প্রায় ৯০০ লাশ দাফনের ভুয়া মৃত্যুসনদ নিজেই তৈরি করেছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এ তথ্য জানিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়েজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ তথ্য জানান।
হারুন অর রশীদ বলেন, মিল্টন সমাদ্দারকে আমরা বুধবার রাতে গ্রেফতার করেছি। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রাতের আঁধারে সিটি করপোরেশনের সনদ ছাড়াই লাশ দাফন করার অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। এই মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়। রিমান্ডে তার আর কী কী অপকর্ম রয়েছে সেগুলোও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তিনি আরো বলেন, রাতের আঁধারে মিল্টন সমাদ্দার লাশ দাফন করতেন। সিটি করপোরেশনের সিল নিজেই মারতেন। সেই কাগজগুলো আমরা জব্দ করেছি। লাশ দাফন করার ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের সনদও নিতেন না। নিজেই লিখে সই করতেন।
মিল্টনের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে কি না জানতে চাইলে ডিবি প্রধান বলেন, মিল্টনকে রিমান্ডে আনার পর তার স্ত্রীকেও ডাকা হবে। তবে কোনো ভুক্তভোগী যদি মামলা করেন তাহলে তার স্ত্রীকেও আমরা গ্রেফতার করব। মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতারের পর বুধবার রাতে ডিবি প্রধান বলেন, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিল্টন সমাদ্দারকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের কাছে বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে। সেগুলোর প্রেক্ষিতে আমরা তাকে পাইকপাড়ার কার্যালয় থেকে আটক করেছি। তার বিরুদ্ধে মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে। আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ডে এনে তাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ উঠেছে এগুলো তদন্ত করে দেখব।
বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে মানবপাচার, শিশু ও বৃদ্ধদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি করার অভিযোগ আছে। এগুলো আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে দেখব। এ ছাড়া তিনি যে অনুদানের টাকা পেতেন তা যথাযথভাবে খরচ করা হতো কি না, তার শেল্টার হোমে শিশু ও বৃদ্ধ যারা আশ্রিত থাকতেন, তাদের অভিভাবকরা এলে তাদের যে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোও খতিয়ে দেখা হবে।
মিল্টন সমাদ্দারের সংস্থার অপারেশন থিয়েটারের লাইসেন্স ছিল না, সেখানে অবৈধভাবে অপারেশন করা হতো উল্লেখ করে ডিবি প্রধান বলেন, বরিশালের উজিরপুরের মিল্টন সমাদ্দারের উত্থান নিজ পিতাকে পিটিয়ে। এই অপরাধে এলাকাবাসী তাকে বাড়ি ছাড়া করেন। এরপর ঢাকার শাহবাগে এসে একটি ফার্সেমিতে কাজ শুরু করেন তিনি। ওষুধ বিক্রির টাকা চুরি করায় সেখানেও বেশিদিন টিকতে পারেননি মিল্টন। এরপর মিঠু হালদার নামের এক নার্সকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ওল্ড অ্যান্ড চাইল্ড নামের একটি কেয়ার সেন্টার স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন তারা। পরবর্তীতে মিরপুর এলাকায় চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার নামের একটি কেয়ার সেন্টার স্থাপন করেন। সে খুঁজে খুঁজে গরিব, বৃদ্ধ ও বাচ্চা শিশুদের সেখানে নিয়ে আসতো। বিভিন্ন মিডিয়ায় সমাদ্দার জানিয়েছে, তার কেয়ার সেন্টারে অপারেশন থিয়েটার আছে এবং সেখানে তিনি মানুষের সেবা দেয়। অপারেশন থিয়েটার থাকলে তো লাইসেন্স থাকতে হবে, তার লাইসেন্স ছিল না।
হারুন অর রশীদ আরো বলেন, মিল্টনের বিরুদ্ধে আমরা অজস্র অভিযোগ পেয়েছি। সে বলেছে, তার দুইটা আশ্রম রয়েছে? সাভারের আশ্রমে ৫ থেকে ৭ শত লোক রয়েছে? কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে ২০ থেকে ৩০ জনের বেশি লোক নেই। মিল্টনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করব কত সংখ্যক মানুষ তার কাছে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল, কত সংখ্যক মানুষ মারা গেল। তার আশ্রমে যে অপারেশন থিয়েটার রয়েছে এর মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করেছেন কি না সেটাও তদন্ত করা হবে।
উজিরপুরে মিষ্টি বিতরণ : এদিকে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করায় তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে মিষ্টি বিতরণ করেছেন এলাকাবাসী। বুধবার রাতে তার গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্র এই মিষ্টি বিতরণ করেন তারা। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ডিবি পুলিশের একটি দল ঢাকার মিরপুর থেকে মিল্টনকে গ্রেফতার করে।মানবিক মুখোশের আড়ালে ভয়ঙ্কর মিল্টন সমাদ্দার এবং জীবনের ধাপে ধাপে প্রতারণার সংবাদে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। মুখ খুলতে শুরু করেন ভুক্তভোগীরা। এরপর মাঠে নামেন ডজন ডজন সাংবাদিক। উঠে আসে তার একের পর এক ভয়ঙ্কর প্রতারণা আর অপকর্মের তথ্য।
উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য স্বপন হাওলাদার বলেন, মানবতার ফেরিওয়ালার আড়ালে মিল্টন সমাদ্দার যেসব অপকর্ম করেছে তার সঠিক বিচার চাই। সমাদ্দার আমাদের এলাকার কলঙ্ক। আমরা এলাকাবাসী তার আটকের খবর শুনে খুশি হয়েছি। পাশাপাশি প্রশাসনের নিকট ন্যায়বিচার দাবি করছি।
বৈরকাঠি গ্রামের বাসিন্দা পলাশ বলেন, মিল্টন সমাদ্দারের অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ ছিলাম। বিশেষ করে তার অন্যায় কাজের কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করত মিল্টন সমাদ্দার। তার আটক হওয়ার খবর শুনে আমরা এলাকাবাসী আনন্দিত হয়েছি। এমনকি ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন ইতোমধ্যে এই সংবাদ পেয়ে এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করে উল্লাস করেছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা