আরো ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট তাপপ্রবাহ মে পর্যন্ত গড়াবে
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে ৪২.৪ ডিগ্রি- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৪৪
প্রচণ্ড তাপে এবার পিচঢালা রাস্তাও নরম হয়ে যেতে শুরু করেছে। আজ দেশের বেশির ভাগ স্থানে তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। আবহাওয়া অফিস গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে আরো তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি করেছে। এটি নিয়ে তিনবার হিট অ্যালার্ট জারি করতে হলো। গত ৩১ মার্চ থেকে দেশের কিছু অংশে প্রচণ্ড গরমের মধ্য দিয়ে তাপপ্রবাহ শুরু। এর পর থেকে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগ ছাড়া সারা দেশেই ছিল মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহের কবলে। কিন্তু চলতি এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে দেশের কিছু অংশে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, শিগগিরই তাপপ্রবাহ কমে যাচ্ছে না। আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহের পুরো সময়টাই থাকবে তাপপ্রবাহের কবলে।
এই গরমে এখন দেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হঠাৎ করে প্রচণ্ড জ্বর, তা থেকে সর্দি-কাশি ও বয়স্কদের হাঁপানি শুরু হয়ে গেছে। অন্য দিকে প্রচণ্ড গরম থেকে একটু স্বস্তি পেতে মানুষ ঝুঁকছে ঠাণ্ডা পানীয়ের প্রতি। ঠাণ্ডা পানীয় পান করে বাড়ছে আরো সর্দি-কাশি ও জ্বর। অন্য দিকে রাজধানীতে ফুটপাথে বরফমিশ্রিত শরবত পানের ব্যবসা এখন জমে উঠেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, গরম থেকে স্বস্তি পেতে এভাবে ঠাণ্ডা পানীয় পানে জ্বর-কাশি বেড়ে যেতে পারে। তারা বলছেন, বাইরে থেকে ঘরে প্রবেশ করে চোখে-মুখে ঠাণ্ডা পানি ছিটিয়ে পাখার নিচে বসে নিজেকে ঠাণ্ডা করে নিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। তাতে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। আর রাস্তার বরফ মিশ্রিত ঠাণ্ডা শরবত পান না করাই ভালো। কারণ এই পানি কতটুকু বিশুদ্ধ তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এই পানি পান করলে হয়তো সাময়িক স্বস্তি মিলবে কিন্তু তা থেকে হেপাটাইটিস, ডায়রিয়া অথবা আমাশয়ের জীবাণুতে সংক্রমিত হতে পারেন পানকারী। একটা গ্লাস দিয়ে যে কতজন পান করেন এই হিসাব নেই। কোনো মানুষের মুখে কী জীবাণু রয়েছে, তা কেউ জানেন না। অতএব রাস্তার এই পানি থেকে সাবধান।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ ড. মো: আবুল কালাম মল্লিক নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, চলতি তাপপ্রবাহ মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে হয়তো কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বয়ে যেতে পারে। তাতে সাময়িক তাপমাত্রা কিছুটা কমে যেতে পারে কিন্তু পরক্ষণই আবারো উচ্চ তাপমাত্রায় অস্বস্তি তৈরি হতে পারে। আবুল কালাম মল্লিক বলেন, বাংলাদেশে এপ্রিল অথবা মে মাসটি এমনিতেই গরম থাকে। কিন্তু এ বছরটি একটু বেশিই গরম।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী সিনিয়র গ্লোবাল ফিউচার সায়েন্টিস্ট ড. রাশেদ চৌধুরী বলছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে এর একটি সম্পর্ক আছে। তিনি বলেন, আগামী জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে বন্যা হতে পারে। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, শিগগিরই প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে বিরাজমান এল নিনু অবস্থা পরিবর্তন হয়ে লা নিনাতে রূপান্তর হতে যাচ্ছে। এই এল নিনু থেকে লা নিনায় পরিবর্তন ঘটলে আমেরিকার অ্যারিজোনাতে শুরু হবে প্রচণ্ড শুষ্কতা ও বাংলাদেশে দেখা দিতে পারে ব্যাপক বন্যাপ্রবাহ। এমনিতেই চলতি এপ্রিল মাসের উচ্চ তাপমাত্রা আগের বছরের উচ্চ তাপমাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে।চলতি মাসে যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকালও দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৪২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আজ শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আজ সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে।
চুয়াডাঙ্গা ও যশোর জেলার ওপর দিয়ে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর ও সৈয়দপুর জেলাসহ খুলনা বিভাগের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং ঢাকা মাদারীপুর, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, বগুড়া, নওগা, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, ফেনী, বান্দরবান ও নোয়াখালী জেলাসহ বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।
চুয়াডাঙ্গার বাতাসে আগুনের হলকা
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, গত দুই সপ্তাহ ধরে চুয়াডাঙ্গায় অব্যাহত রয়েছে তীব্র তাপদাহ। এখানের বাতাসে যেন বইছে আগুনের হলকা। দিনের আলো ফোটার পর বেলা যত বাড়তে থাকে সূর্যের চোখ রাঙানো ততই বাড়তে থাকে। গতকাল বেলা ৩টায় চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১৪ শতাংশ।
এদিকে তীব্র তাপদাহে গলে যাচ্ছে সড়কের পিচ। ভুগর্ভের পাস্তর নিচে নেমে যাওয়ায় চুয়াডাঙ্গার গ্রামাঞ্চলে টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। পানির অভাবে রক্ষা করা যাচ্ছে না মাঠের ফসল। শুকিয়ে যাচ্ছে সড়কের ধারের বিভিন্ন ফলদ ও বনজ গাছের পাতা।
চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমের শুরু থেকে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়ে আসছে এই জেলায়। একটানা ১৪ দিন তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপমাত্রার কারণে হাসপাতালে বেড়েই চলেছে জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। জেলা হাসপাতালটি ২৫০ শয্যার হলেও চিকিৎসক রয়েছে ১০০ শয্যার হাসপাতালের অর্ধেক। সামান্য এই জনবল নিয়ে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তাররা। শয্যার সংকুলান না হওয়ায় রোগীরা হাসপাতালের বারান্দা ও করিডোরে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রচণ্ড গরমে শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাভ্যান চালকরা কাজ করতে না পেরে অলস সময়ও পার করছেন। একটু প্রশান্তির খোঁজে গাছের ছায়া ও ঠাণ্ডা পরিবেশে স্বস্তি খুঁজছে স্বল্প আয়ের মানুষরা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ছে। তবে অনেকে জীবিকার তাগিদে প্রচণ্ড তাপদাহ উপেক্ষা করে কাজে বের হচ্ছেন।
চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণীর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ইনচার্জ জামিনুর রহমান জানান, গত ১৪ দিন ধরে চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করছে। জেলায় হিট এলার্ট জারি আছে। এর মধ্যে তাপমাত্রার পারদ সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রিতে উঠা-নামা করছে। এপ্রিল মাসজুড়েই এ অবস্থা থাকবে। তাপমাত্রা আরো বাড়বে।
ঈশ্বরদীতে তাপমাত্রা ৪১.৫ ডিগ্রি
ঈশ্বরদী (পাবনা) সংবাদদাতা জানান, ঈশ্বরদীতে তীব্র তাপপ্রবাহ বিরাজ করছে। গতকাল উপজেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই ৪০-৪২ ডিগ্রিতে তাপমাত্রা উঠানামা করছে। আবহাওয়ার এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন ঈশ্বরদী আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ হেলাল উদ্দিন।
তীব্র তাপদাহে জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়রিয়াসহ নানা রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দীর্ঘ হচ্ছে রোগীর সিরিয়াল। স্ব^াস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শিশু রোগীর সংখ্যা বেশি।
তীব্র রোদ ও গুমোট আবহাওয়ায় মানুষের পাশাপাশি পশুপাখিরাও হাঁসফাঁস করছে। অনেকে সামান্য স্বস্তির জন্য ছুটে চলছেন গাছের ছায়াতলে। তীব্র রোদ ও গরমে স্বস্তি পেতে অনেকেই ছুটছেন আখের রস, তরমুজ, লেবুর শরবত, ঠাণ্ডা মাঠা, শসা ও ডাবের পানির দিকে। ঈশ্বরদী উপজেলা প্রশাসন থেকে হিট অ্যালার্ট এবং তাপদাহ থেকে রক্ষায় করণীয় বিষয়ে প্রচার চালানো হচ্ছে। তীব্র তাপদাহের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে বিদ্যুতের লোডশেডিং।
নোয়াখালীতে শিক্ষার্থীর মৃত্যু
নোয়াখালী অফিস জানায়, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে হিট স্ট্রোকে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। নিহত ঋতু সুলতানা (১৫) উপজেলার ছয়ানী ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাদারি গ্রামের কবিরাজবাড়ির মো: ইসমাইলের মেয়ে। সে স্থানীয় ছয়ানী উচ্চবিদ্যালয় থেকে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। গতকাল বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিশ্চিত করেন ছয়ানী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মনির হোসাইন।
নিহতের বাবা ইসমাইল জানান, বুধবার রাত আড়াইটার দিকে ঋতু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তিনি স্থানীয় একজন গ্রাম্য চিকিৎসককে ডেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিন্তু ডাক্তার আসার আগে সে মারা যায়। গ্রাম্য চিকিৎসক ধারণা করেন হিট স্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে সিভিল সার্জন ডা: মাসুম ইফতেখারের মুঠোফোনে বারবার কল করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
অতিষ্ঠ রাজনগরের মানুষ
রাজনগর (মৌলভীবাজার) সংবাদদাতা জানান, তাপদাহে অতিষ্ঠ রাজনগরের জনজীবন। বৈরী এ পরিস্থিতিতে চরম বিপাকে পড়েছেন দরিদ্র কৃষকসহ শ্রমজীবীরা। প্রচণ্ড তাপদাহের মধ্যেই কৃষকরা উৎপাদিত বোরো ফসল ঘরে তুলতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে অনেকেই ঘরের বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছেন না।
রাজনগরের বিভিন্ন এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জানাযায়, হঠাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার শস্যভাণ্ডার খ্যাত কাউয়াদীঘি হাওরসহ উজানে বোরো ধান কাটায় নিয়োজিত ২৬ হাজার কৃষক এবং শ্রমিকসহ এলাকার বৃদ্ধ ও শিশুরা সমস্যায় রয়েছেন। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ডায়রিয়া, জ্বর, নিমোনিয়া, সর্দি-কাশিজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা যায়, গতকাল জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৬.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গত এক সপ্তাহের গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা