ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ডের পর আল শিফা ছাড়ল ইসরাইলি সেনারা
নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে সমাবেশে লাখো ইসরাইলি- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ০২ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫৮
দুই সপ্তাহের ধ্বংসাত্মক ও প্রাণঘাতী অভিযানের পর অবশেষে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার বৃহত্তম আল-শিফা হাসপাতাল থেকে সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে ইসরাইল। ভবনের ধ্বংসাবশেষ আর আবর্জনার মাঝে ফিলিস্তিনের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশ রেখে ইসরাইলি সৈন্যরা হাসপাতালটি ত্যাগ করেছে। গতকাল সোমবার ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর এক বিবৃতিতে সৈন্যদের প্রত্যাহারের তথ্য জানানো হয়েছে। আলজাজিরা, রয়টার্স ও এএফপি।
রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে, ইসরাইলি সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর শত শত বাসিন্দা গাজা উপত্যকার বৃহত্তম হাসপাতালের আশপাশে ছুটে আসেন। ইসরাইলি সৈন্যদের দীর্ঘদিনের আগ্রাসনের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখতে সেখানে হাজির হয়েছেন আশপাশের বিভিন্ন আবাসিক জেলার বাসিন্দারা।
ইসরাইলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, দুই সপ্তাহের অভিযানে হাসপাতাল এলাকায় কয়েক শ’ বন্দুকধারীকে হত্যা ও আটক করা হয়েছে। এছাড়া হাসপাতাল থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোয়েন্দা নথিও জব্দ করেছে তারা। তবে হামাস ও চিকিৎসাকর্মীরা আল-শিফা হাসপাতালে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের সশস্ত্র উপস্থিতির ইসরাইলি দাবি নাকচ করেছে।
গাজার বেসামরিক জরুরি সেবা বিভাগের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ইসরাইলি বাহিনী দু’জনকে এমনভাবে হত্যা করেছে; যাদের লাশ ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হাতকড়া পরা অবস্থায় পাওয়া গেছে। ইসরাইলের সৈন্যরা হাসপাতাল চত্বরে কবর দেয়া লাশগুলো বুলডোজার ব্যবহার করে উত্তোলন করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আল-শিফা হাসপাতাল এলাকার কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, হাসপাতালের ধ্বংসস্তূপের মাঝে ও চত্বরে অনেক ফিলিস্তিনির লাশ পড়ে আছে। কিছু কিছু লাশ নোংরা কম্বলে ঢেকে রাখা হয়েছে।
ছবিতে দেখা যায়, হাসপাতাল ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভবনের বাইরে মাটি খুঁড়ে গভীর গর্ত করা হয়েছে। কোনো ভবনই অক্ষত নেই। হয় পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে নতুবা মাটিতে মিশিয়ে ফেলা হয়েছে। আল-শিফা হাসপাতাল দেখতে যাওয়া সামির বাসেল নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমি এখানে পৌঁছানোর পর আমার কান্না থামাতে পারিনি। দখলদার বাহিনী এখানে ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছে। এলাকাটি ধ্বংস করা হয়েছে। ভবনগুলো পুড়িয়ে ফেলেছে অথবা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এই স্থানটি আবার নির্মাণ করা দরকার। এখানে শিফা হাসপাতালের কোনো অস্তিত্ব নেই।
এদিকে গাজার আল-শিফা হাসপাতাল থেকে রোগীদের সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান তেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসিস। রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, গত ১৮ মার্চ থেকে ইসরাইলি হামলায় অন্তত ২১ রোগী মারা গেছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা এ খবর জানিয়েছে।
এক্সে দেয়া পোস্টে আল-শিফা হাসপাতালে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলা ইসরাইলি আগ্রাসনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন ডব্লিউএইচও প্রধান। তিনি বলেছেন, হাসপাতালের বিধ্বস্ত ভবনের মধ্যে এখনো ১০৭ জন রোগী আছেন, যাদের অবস্থা খুবই করুণ। তাদের জন্য নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা। এছাড়া প্রয়োজনীয় ওষুধ থেকে শুরু করে কোনো রকম পথ্য বা অন্যান্য সামগ্রীরও অভাব রয়েছে।
হাসপাতালে গুরুতর ২৮ রোগী ও ৪ শিশু রয়েছে দাবি করে তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়াসিস আরো জানান, তাদের জন্য ডায়াফার, ইউরিন ব্যাগ এমনকি ক্ষতস্থান পরিষ্কারের জন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থাও নেই। পানির অভাব বিশেষভাবে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে তিনি জানান, গতকাল শনিবার পর্যন্ত প্রতি ১৫ জনের জন্য শুধু একটি পানির বোতল অবশিষ্ট ছিল।
এছাড়া খাবারের পরিমাণও সীমিত যা ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য জীবনের হুমকিস্বরূপ বলেও উল্লেখ করেছেন ডব্লিউএইচও প্রধান। হাসপাতালে অবিলম্বে ত্রাণসতায়তা পাঠাতে মানবিক কর্মীদের সেখানে প্রবেশে ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল সোমবার জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত গাজায় ৩২ হাজার ৮৪৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। তাছাড়া ইসরাইলি হামলায় অন্তত ৭৫ হাজার ৩৯২ জন আহত হয়েছেন। উপত্যকাটিতে গত ২৪ ঘণ্টায়, ৬৩ জন নিহত এবং ৯৪ জন আহত হয়েছেন।
৬০০ ইসরাইলি সেনা নিহত : এদিকে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, গাজায় অভিযানের সময় আরো এক ইসরাইলি সেনা প্রাণ হারিয়েছে। ২০ বছর বয়সী ওই সেনার নাম নাদাভ কোহেন। এ নিয়ে গাজায় গত ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ৬০০ ইসরাইলি সেনা প্রাণ হারিয়েছে। গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলের সীমান্তে প্রবেশ করে আকস্মিক হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এরপরই গাজায় পাল্টা আক্রমণ চালায় ইসরাইল। গাজার উত্তর, দক্ষিণ এবং মধ্যাঞ্চলে কোনো স্থানই ইসরাইলি আগ্রাসন থেকে রেহায় পায়নি।
হামাসপ্রধানের বোনকে গ্রেফতার : অভিযান চালিয়ে হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়ার বোনকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরাইলি বাহিনী। সোমবার ইসরাইলি প্রতিরক্ষা সূত্রের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, ইসমাইল হানিয়ার এক বোনকে হামাসের অপারেটিভদের সাথে যোগাযোগ এবং সন্ত্রাসী কাজে সমর্থন করার সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছে। ইসরাইল পুলিশ এক বিবৃতিতে বলেছে যে, তারা শিন বেটের সাথে যৌথ অভিযানে ৫৭ বছর বয়সী একজন নারীকে গ্রেফতার করেছে। তিনি হামাসের একজন সিনিয়র সদস্যের আত্মীয়।
বিবৃতিতে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে যে, তিনি দক্ষিণাঞ্চলীয় তেল শেভা শহরের বাসিন্দা, সেখানে অভিযান চালানো হয়েছিল। তবে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিশ্চিত করেছে যে, নারীটি ইসমাইল হানিয়ার বোনদের একজন। চ্যানেল ১২ জানিয়েছে, পুলিশ পরে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে সাবাহ আবাদ আল-সালাম হানিয়া বলে শনাক্ত করেছে।
নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে সমাবেশে লাখো ইসরাইলি : ইসরাইলের বেনজামিন নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে জেরুসালেমে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে লাখো মানুষ। তারা সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব থেকে অতি-নিষ্ঠাবান ইহুদিদের ছাড় দেয়ার বিরুদ্ধেও বিক্ষোভ দেখিয়েছে। গত বছর একই ধরনের ব্যাপক বিক্ষোভে নেতানিয়াহু সরকারের অবস্থা টালমাটাল হয়ে উঠেছিল। ওই আন্দোলনের সাথে জড়িত কিছু গোষ্ঠীসহ অনেকগুলো প্রতিবাদী গোষ্ঠী রোববার ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেটের সমানে এ সমাবেশের আয়োজন করে। সমাবেশ থেকে সরকার পরিবর্তনে নতুন নির্বাচনের দাবি জানানো হয়।
বিক্ষোভকারীরা ইসরাইলি পতাকা দুলিয়ে ‘এখনই নির্বাচন দাও’ বলে স্লোগান দেয়। ইসরাইলিদের জন্য সামরিক পরিষেবায় অংশ নেয়া বাধ্যতামূলক। প্রতিবাদকারীরা সামরিক পরিষেবার দায়িত্বে কাউকে ছাড় না দিয়ে সবার সমান অংশগ্রহণের দাবি জানান। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের নজিরবিহীন আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছে। বেশ কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছে এ যুদ্ধে।
ইসরাইলের এন-টুয়েলভ নিউজ জানিয়েছে, গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইলের সরকারের বিরুদ্ধে এটিই সবচেয়ে বড় সমাবেশ বলে ধারণা করা হচ্ছে। হারেৎজ ও ওয়াইনেট নিউজ জানিয়েছে, সমাবেশে প্রায় লাখখানেক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। হামাসের যোদ্ধাদের হামলায় ১২০০ মানুষ নিহত হয়েছে বলে ভাষ্য ইসরাইলের। এর পাশাপাশি হামাস যোদ্ধারা ইসরাইলে থেকে ২৫০ জনেরও বেশি মানুষকে ধরে নিয়ে গাজায় জিম্মি করে রাখে। দক্ষিণ ইসরাইলে হামাসের এ হামলার ঘটনায় নিরাপত্তা ব্যর্থতার জন্য নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে।
সমাবেশে যোগ দেয়া নুরিত রবিনসন (৭৪) বলেন, ‘এই সরকার পুরোপুরি ও সম্পূর্ণ ব্যর্থ। তারা আমাদের নরকে নিয়ে যাবে।’ ফিলিস্তিনি ছিটমহল গাজায় যুদ্ধ ইসরাইলের সমাজে বহু দিন ধরে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের উৎসগুলোকে আরো তীব্র করে তুলেছে। ইহুদি ধর্মীয় শিক্ষালয়গুলির অতি-নিষ্ঠাবান শিক্ষার্থীদের দেশটির সামরিক বাহিনীর বাধ্যতামূলক দায়িত্ব থেকে ছাড় দেয়া এর অন্যতম। এর জেরে নেতানিয়াহুর জোট সরকারও নড়বড়ে হয়ে গেছে।
এই ইস্যুটি নিয়ে কয়েক দশক ধরে চলা অচলাবস্থা নিরসনে ৩১ মার্চের মধ্যে আইন প্রণয়নের জন্য সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। শেষ মুহূর্তে আবেদন করে এই সময়সীমা আরো একমাস বাড়িয়েছেন নেতানিয়াহু। এরপরই রোববার তার সরকারের বিরুদ্ধে অন্যতম বৃহত্তম এ সমাবেশটি হয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা