১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে উত্তাল বুয়েট

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমাবেশ : নয়া দিগন্ত -


- গভীর রাতে ক্যাম্পাসে বহিরাগত ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা
- প্রতিবাদে ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের পদত্যাগ দাবি

গভীর রাতে একটি বিশেষ রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাসে প্রবেশের ঘটনায় ফের উত্তাল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ব্যর্থতার দায়ে বুয়েট ছাত্রকল্যাণ পরিদফতরের পরিচালক (ডিএসডব্লিউ) অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমানের পদত্যাগ দাবি করেছেন শিক্ষার্থীরা।
গতকাল শুক্রবার (২৯ মার্চ) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রশাসনিক ভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এ আহ্বান জানান। গতকাল দুপুর থেকে ছয় দফা দাবি নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে জড়ো হয়ে আন্দোলন শুরু করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা, ‘এক, দুই, তিন, চার ডিএসডব্লিউ গদি ছাড়’, ‘আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেবো না’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, ডিএসডব্লিউকে না জানিয়ে বা তার অজান্তে কোনোভাবেই ছাত্রসংগঠনের নেতারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে না। এর দায়ভার তাকেই নিতে হবে। আমরা চাই তিনি পদত্যাগ করুক। এ সময় বুয়েট শিক্ষকরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আশ্বাস দিতে এলে ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান তোলেন শিক্ষার্থীরা।
জানা যায়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ফের ছাত্র রাজনীতি প্রবেশের চেষ্টার অভিযোগে তুলে রাজনীতি প্রতিরোধে ছয় দফা দাবিতে ফের অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষার্থীরা। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত (শুক্রবার সন্ধ্যা ৮টা ৩০) তারা ছাত্রকল্যাণ পরিদফতর অফিসের সামনে অবস্থান করছিলেন।

এর আগে গতকাল শুক্রবার বিকেলে বুয়েট শহীদ মিনারের পাদদেশে এক সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফা দাবি জানান শিক্ষার্থীরা। সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সবচেয়ে সমাদৃত এবং শীর্ষস্থানীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর এ আবরার ফাহাদ ভাই এর নৃশংস মৃত্যুর মাধ্যমে বুয়েট বাংলাদেশের সবচেয়ে নিরাপদ ক্যাম্পাসে রূপ নেয়। বুয়েটে সর্বশেষ ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে যে নিরাপদ এবং সুন্দর একটি ক্যাম্পাস আমরা উপহার হিসেবে পেয়েছি, তা দেশব্যাপী সবার কাছে প্রশংসিত ও অনুকরণীয়। দেশের সব মানুষ, নানা প্রান্তের নানা প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থী দেখেছে একটি রাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের রোল মডেল, তার সুফল, তার সৌন্দর্য, তার উৎকর্ষের যত সমূহ সম্ভাবনা।

তারা বলেন, তবে যে কলুষিত হাতগুলোর কারণেই ঝরে গিয়েছিল আমাদেরই নিষ্পাপ মেধাবী প্রাণ, সে কলুষিত হাতগুলো পরে বারে বারে ভিন্ন ভিন্নভাবে পুনরায় সে অপরাজনীতির অনুপ্রবেশের অপচেষ্টা চালিয়েছে, ক্যাম্পাসের এই সুন্দরতম ভিত্তিকে পুনরায় ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে। তবে ২০১৯-এর সেই সময়টির পর থেকে বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে উদ্যম, সৎ সাহস আর প্রেরণা পেয়েছিল সেটিই প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ছাত্ররাজনীতি অনুপ্রবেশ এর সব অপচেষ্টাকে রুখে দিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট ঐক্য গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছিল। তবে এখনো বারে বারে পড়াশোনা কিংবা একাডেমিকস এর চূড়ান্ত চাপ থাকার পরেও আমাদের এই নিরাপদ ক্যাম্পাসটিকে রক্ষা করতে আমাদের সর্বদা সজাগ থাকতে হয়, করতে হয় নিরন্তর নিয়মিত সংগ্রাম। শিক্ষার্থীদের যেন সেই কলুষিত হাতদের বিরুদ্ধে ন্যায়ের লড়াই, সত্যের লড়াই চালিয়ে যাওয়া যেন শিক্ষাজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং নিত্য অংশ হয়ে গিয়েছে।
বুয়েটের শিক্ষার্থীরা বলেন, এমনই একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা আমাদেরই এই প্রাণের বুয়েট ক্যাম্পাসে ঘটে গত ২৮ মার্চ, ২০২৪ মধ্যরাতে। রাত ১টার দিকে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানতে পারি, বুয়েটে একটি বিশেষ রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের বেশ ক’জন শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ এসেছেন এবং তারা ক্যাম্পাসের মেইন গেট দিয়েই প্রবেশ করে ভেতরে ঢুকেছেন। রাত সাড়ে ১০টার পরে যেখানে নিরাপত্তাজনিত কারণে আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীদেরই ক্যাম্পাসে ঢোকার অনুমতি নেই সেখানে রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট বহিরাগত ব্যক্তিদের মধ্যরাতেই আমাদের প্রাণের ক্যাম্পাসে অনুপ্রবেশ ঘটে। ঘটনার তীব্রতা বাড়তে থাকে রাত বাড়ার সাথে সাথে, একের পর এক বহিরাগত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ক্যাম্পাসের মেইন গেটের সামনে আসতে থাকে।

তারা আরো বলেন, বিপুল সংখ্যক বহিরাগত ক্যাম্পাসে অনায়াসে প্রবেশ করতে থাকে এবং একপর্যায়ে সেখানে উপস্থিত সাধারণ শিক্ষার্থীরা দেখতে পায়, মিছিলের মতো করে বিশাল একটি জনবহর হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে আমাদের ক্যাম্পাসে রাত ২টার পর প্রবেশ করতে থাকে। দুঃখজনকভাবে, এই বিশাল জনবহর এর সবাই বহিরাগত ছিল এবং তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভেতরে প্রবেশ করে মধ্যরাতের সেই সময়টাই বিশেষ ওই ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দদের চিনতে পারে, যা সুস্পষ্ট জানান দেয় এত বিপুল জনসমাগম রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী সাংগঠনিক রাজনীতি নিষিদ্ধ এমন একটি ক্যাম্পাসে রাতের আঁধারে ঘটে যাওয়া এত বড় একটি রাজনৈতিক সমাগম এবং বহিরাগতদের আগমন ক্যাম্পাসের মর্যাদার প্রতি তীব্র অপমানজনক। একই সাথে এটি একটি নিরাপদ ক্যাম্পাস এবং শিক্ষার্থীদের সুষ্ঠু স্বাভাবিক শিক্ষা পরিবেশের নিরাপত্তার ব্যাপারকে গুরুতরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এবং ছাত্রকল্যাণ পরিদফতর কোনোরূপেই ওই ন্যক্কারজনক ঘটনা ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়ার দায় এড়িয়ে যেতে পারে না।

তারা বলেন, মধ্যরাতে বহিরাগত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের এমন দাপটসহ প্রবেশ কর্তৃপক্ষ এবং ডিএসডব্লিউর দৃষ্টির অগোচরে হওয়া অসম্ভব। ঘটনা ঘটে যাওয়ার দেড় দিন পার হয়ে গেলেও ডিএসডব্লিউ থেকে ওই ঘটনার সাথে সম্পর্কিত কোনো প্রকার সদুত্তর এবং জবাবদিহিতা এখন পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে আসেনি। ক্যাম্পাসে মধ্যরাতে তারা প্রবেশের অনুমতি কিভাবে কর্তৃপক্ষ থেকে পেয়েছিল এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটি এখনো ধোঁয়াশাপূর্ণ এবং সন্দেহের সঞ্চার করে যে কিভাবে এবং কোনো মদদে তারা প্রবেশ করতে পারল। এর সমস্তই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাকে বিঘিœত করে।
ছয় দফা দাবি জানিয়ে বক্তারা বলেন, এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েটে বর্তমানে চলমান পাঁচটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিপুল সমালোচনার ঝড় ওঠে, তারা তাদের নিন্দা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এবং প্রতিটি আলাদা আলাদা ব্যাচ নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনা করে, তা অন্য ব্যাচদের সামনে তুলে ধরে এবং পরিশেষে সব ব্যাচ কিছু সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এবং দাবি দাওয়ায় উপনীত হয়। ক্যাম্পাসের সবচেয়ে অগ্রজ ব্যাচ ইন্টার্ভাল প্রতিটি ব্যাচের ঐক্যবদ্ধ দাবিগুলোকে সুসংগঠিত করে নিম্নে পেশ করে।

দফাগুলো হলো- ১. বিশ্ববিদ্যালয়ের সুস্পষ্ট বিধিমালা লঙ্ঘনের দায়ে আমরা বুয়েটের সব ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ২৮ মার্চের মধ্যরাতে রাজনৈতিক সমাগমের মূল সংগঠক ইমতিয়াজ রাব্বির বুয়েট থেকে স্থায়ী বহিষ্কার এবং হল আবাসন বাতিল করতে হবে, ২. ওই ঘটনায় ইমতিয়াজ রাব্বির সাথে বুয়েটের বাকি যেসব শিক্ষার্থী জড়িত ছিল তাদের বিভিন্ন মেয়াদে হল ও টার্ম বহিষ্কার করতে হবে, ৩. বহিরাগত রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ যারা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা, তারা কেন কিভাবে প্রবেশ করার অনুমতি পেল এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট সদুত্তর এবং জবাবদিহিতা বুয়েট প্রশাসনক দিতে হবে; ৪. উপরি উক্ত ১নং এবং ২ নং দাবি আজ সকাল ৯টার মধ্যে বাস্তবায়ন করা না হলে সব ব্যাচের শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী ডিএসডব্লিউর পদত্যাগ করতে হবে, ৫. ক্যাম্পাসে মধ্যরাতে বহিরাগতদের প্রবেশের কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত। এর প্রতিবাদ হিসেবে আজ ৩০ ও আগামীকাল ৩১ মার্চের টার্ম ফাইনালসহ সকল একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করা হবে এবং ৬. আন্দোলনরত বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো রকম হয়রানিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে না- এই মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
উল্লেখ্য, গত ২৮ মার্চ রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি, দফতর সম্পাদকসহ অনেকেই বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন। তাদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করানোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ইমতিয়াজ রাব্বির। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার পর বুয়েটে এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে নতুন করে রাজনীতি শুরুর পাঁয়তারা হিসেবে দেখছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যার পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের এই বিক্ষোভ এবং সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো।

 


আরো সংবাদ



premium cement