১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধে জড়িত ৪ সশস্ত্রগোষ্ঠী

-


প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে এক কাপড়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসেছিল রোহিঙ্গারা। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে গণহত্যার শিকার হয়ে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা। এ ছাড়া আগে থেকেই ছিল আরো অনেকে। সব মিলিয়ে আশ্রিত এই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ লাখে। মিয়ানমারের উগ্রপন্থী মগ ও জান্তা বাহিনীর চরম নির্যাতনে রোহিঙ্গাদের কেউ হারিয়েছেন বাবা-মা, আবার কেউ স্ত্রী, ছেলেমেয়েকে। ভাইয়ের সামনে বোনকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। পাখির মতো গুলি করে মারা হয়েছে মুসলিম রোহিঙ্গাদের। তবে একপর্যায়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া এই বিশালসংখ্যক মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে মাদকে সয়লাব হয়ে যায় ক্যাম্পগুলো। আর মাদকের সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণেই গড়ে উঠেছে একের পর এক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। গত অর্ধযুগে শরণার্থী ক্যাম্পগুলো পরিণত হয়েছে বিবদমান এসব গোষ্ঠীর আধিপত্যের যুদ্ধক্ষেত্রে। মাদক কারবার ধরে রাখতেই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হতে দিতে চায় না।

জানা গেছে, উখিয়ায় ২৭টি ও নোয়াখালীর ভাসানচরের একটি আশ্রয় শিবিরে বর্তমানে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর বসবাস। এর মধ্যে উখিয়ার শিবিরগুলো রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে গড়ে উঠেছে চারটি সশস্ত্র সংগঠন। রয়েছে আরো সাতটি ডাকাতদল। এর মধ্যে সবচেয়ে সংগঠিত দলটি হলো আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা। ১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো: ইকবাল বলেন, যখনই সন্ত্রাসীমূলক কর্মকাণ্ডের খবর পাচ্ছি তখনই আমরা অভিযান চালাচ্ছি। কিন্তু সমস্যা হলো বেপরোয়া রোহিঙ্গারা মাদক (ইয়াবা) কারবারের জন্য খুনোখুনির ঘটনা ছাড়ছে না। আধিপত্যের জন্যও তারা অপর রোহিঙ্গাকে হত্যা করছে। উখিয়া থানার ওসি শামীম হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় মানুষের নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এখানকার সুন্দর পরিবেশ তাদের কারণে নষ্ট হচ্ছে। তারা নানান অপরাধে জড়িত।

সম্প্রতি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চারটি সশস্ত্র সংগঠনের তৎপরতার বিস্তারিত। এই চারটি গোষ্ঠী এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে অস্থির করে তুলছে। সংগঠনগুলো হচ্ছে- আরসা, আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন), এআরএ (আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি) ও ইসলামী মাহাজ। একই সাথে গোষ্ঠীগুলোকে নির্মূলের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। এতে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে মোটা দাগে চারটি গোষ্ঠী সক্রিয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও সুসংহত দল আরসা। এর পরই অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়ে সুসজ্জিত দলটি আরএসও। সম্প্রতি আরসা ও আরএসওর মধ্যে সঙ্ঘাত ছড়িয়েছে ব্যাপক। এ ছাড়া সাবেক আরসা সদস্য নবী হোসেন মংডুতে বসেই গড়ে তুলেছেন এআরএ নামে একটি সশস্ত্র দল। মাদক সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে এটিই হয়তো বৃহৎ সশস্ত্র গোষ্ঠী। নবী হোসেনের গ্রুপের বেশির ভাগই আরসার সাবেক সদস্য। আবার আরএসওর একটি অংশ নবী হোসেনের অনুগত। তবে আরেকটি গ্রুপ শিবিরগুলোতে সক্রিয় রয়েছে যারা আরসার সক্রিয় সদস্য ছিল, কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। জানা গেছে, তারাও নবী হোসেনের আনুগত্য বজায় রেখেছে। এর বাইরে রয়েছে রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহর দল ইসলামী মাহাজ।

নেতৃত্বে দিচ্ছে যারা : রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রায়ই সবগুলো গ্রুপেরই নাটাই নবী হোসেনের হাতে। আরএসও, আরসা ও আরসা ত্যাগী দলটির অনেক কমান্ডারই নবী হোসেনের বেতনভুক্ত। কিন্তু নবী হোসেন ক্যাম্পগুলোতে সরাসরি নেতৃত্ব দেন না। তাই একটি কমিটি গঠন করে তার দলকে আরো সুসংহত করতে চায়। কমিটিতে রয়েছে মাস্টার আইয়ুব প্রকাশ নুর ও মাস্টার ইউনুস। এর মধ্যে আইয়ুব পূর্বের রোহিঙ্গা। আর মাস্টার ইউনুস কক্সবাজারে এআরএর প্রেসিডিয়াম সদস্য ও উপদেষ্টা, সাবেক আরসা কমান্ডার মৌলভী ফজল করিমের ছোট ভাই। কমিটির দু’জনেরই ইয়াবা, ক্রিস্টাল মেথ প্রভৃতি মাদক চোরাচালান ও সাধারণ রোহিঙ্গা অপহরণের সাথে জড়িত। সূত্র বলছে, দু’জনই বাংলাদেশী ডকুমেন্ট ব্যবহার করে তিন থেকে চারবার বিদেশ সফর করেছে। তারা আরসা ত্যাগী পক্ষটিকে ব্যবহার করে থাকে। আরসা ত্যাগী গ্রুপে কমপক্ষে দেড় শ’ জনের সশস্ত্রবাহিনী রয়েছে। এ গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে আবদুল হালিম প্রকাশ কেফায়েতুল্লাহ (ক্যাম্প-৭), আমির রফিক প্রকাশ মাস্টার রফিক (ক্যাম্প-৭), মুফতি আনাস (ক্যাম্প-১০), আবু সোয়াব প্রকাশ হামিদ হোসেন (ক্যাম্প-৯) ও ফজল করিম (ক্যাম্প-১৮)। এদের সবার বিরুদ্ধেই পাঁচ থেকে ছয়টি করে মামলা রয়েছে।

সূত্র বলছে, আরসা বিরোধীরাও ইয়াবা সিন্ডিকেটের সাথে হাত মিলিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে। একইভাবে আরএসও ক্যাম্পে শক্তিশালী অবস্থান করেই অপহরণ, ছিনতাইসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে। এরাও অন্যান্য দলের মতো ভয়ঙ্কর গেরিলায় রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। কারণ গোষ্ঠীটির যেমন লোকবল রয়েছে, তেমনি রয়েছে অস্ত্রশস্ত্রও। ক্যাম্পগুলোতে আরএসওর নেতৃত্ব দিচ্ছেন মৌলভী মোহাম্মদ নুর (ক্যাম্প-১১), নুর বশর (হেড মাঝি ক্যাম্প-২ পশ্চিম), কামাল প্রকাশ মোস্তফা কামাল (ক্যাম্প-২ পশ্চিম), সাদ্দাম (ক্যাম্প ১ পশ্চিম), মো: আলী, গান গ্রুপের কমান্ডার মো: ইউনুস, সলিম প্রকাশ হাড্ডি সেলিম (ক্যাম্প-২ পশ্চিম) এবং রুহুল আমিন (ক্যাম্প-১ পশ্চিম)। এরা সবাই আরএসও থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তবে সূত্র জানায়, তারা আরএসওর নেতৃত্ব দিলেও কাজ করে নবী হোসেনের অধীনে। গোষ্ঠীটি সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের সাথে জড়িত। এ ছাড়া দিন দিন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে তারা। এদের মূল গ্রুপ থাকে বান্দরবানের আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায়। এ ছাড়া ঘুমধুম ও জিরো পয়েন্ট সীমান্তে এবং পাহাড়ি এলাকায় তারা অবস্থান করে।

 


আরো সংবাদ



premium cement