সমস্যা সমাধানে বিশ্বনেতারা ব্যর্থ
আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনে জোর প্রধানমন্ত্রীর- ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০
জলবায়ু পরিবর্তন, মরক্কোর সাম্প্রতিক ভূমিকম্প, লিবিয়ায় বন্যা ও আফ্রিকায় অভ্যুত্থানসহ অসংখ্য সমস্যার কথা উল্লেখ করে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে বিশ্বনেতারা ঐক্যবদ্ধ হতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। নিউ ইয়র্ক সিটিতে ৭৮তম জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে (১৯ সেপ্টেম্বর) তিনি এ আহ্বান জানান।
গুতেরেস বলেন, বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। সেই অনুযায়ী বিশ্ব নেতারা প্রতিক্রিয়া জানাতে পারছেন না। এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য বহুপক্ষীয় সংস্থার আধুনিকীকরণ করতে হবে। নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারের ওপর জোর দিয়েছেন জাতিসঙ্ঘ প্রধান। তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও বৈশ্বিক সংস্থাগুলো সংস্কার করতে হবে। তা ছাড়া সব কিছু ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। পৃথিবী বদলে গেছে। আমাদের সংস্থার গঠন ও ভাবধারা কেন বদলাবে না।
‘বৈশ্বিক সমঝোতার’ আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিটি দেশ যদি জাতিসঙ্ঘের সনদ অনুযায়ী কাজ করে তবে শান্তি নিশ্চিত হবে। গুতেরেস বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন জাতিসঙ্ঘের শক্তিশালী সদস্যদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে। দিন দিন সম্পর্ক খারাপের দিকে যাচ্ছে। বহু মানুষ জীবন হারিয়েছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, পরিবারগুলো ছিন্নভিন্ন হয়েছে, শিশুদের আঘাত করা হয়েছে, অনেক আশা ও স্বপ্ন ভেঙে দেয়া হয়েছে। জলবায়ু সঙ্কট, লিঙ্গ বৈষম্য ও চরম দারিদ্র্য মোকাবিলায় বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব।
ভাষণে জি-২০ দেশগুলোর সমালোচনা করেন তিনি। গুতেরেস বলেন, বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের জন্য এই দেশগুলো দায়ী। এই দেশগুলো ৮০ শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন করে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহযোগিতা জোরদার করতে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানবসৃষ্ট দুর্যোগকে আরো খারাপ করে তুলছে উল্লেখ করে সব দেশকে বৈশ্বিক মানবিক সহযোগিতায় অর্থায়নের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। অস্থিতিশীল বৈষম্য, জলবায়ু সঙ্কট ও অকার্যকর নেতৃত্বের একটি ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন বাড়ছে। গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ছে। কর্তৃত্ববাদ অগ্রসর হচ্ছে। বৈষম্য বাড়ছে। গুতেরেস বলেন, আমাদের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের তালিকা দীর্ঘ হলেও দৃঢ়সংকল্প আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আসুন আমরা বিভেদ ভুলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হই।
খাদ্য সরবরাহকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে রাশিয়া : জলেনেস্কি
জাতিসঙ্ঘে দেয়া ভাষণে ইউক্রেনের প্রসিডেন্ট জেলেনেস্কি বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ব্ল্যাক ও আজভ সাগরে ইউক্রেনের বন্দরগুলো রাশিয়া ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা অবরুদ্ধ করে রেখেছে। রাশিয়া এই পদক্ষেপ বিশ্ববাজারে খাদ্য ঘাটতিকে অস্ত্রে পরিণত করার একটি সুস্পষ্ট প্রয়াস। এই অস্ত্রায়নের প্রভাব আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত দেখা দিয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, খাদ্য সরবরাহে বাধা দেয়াকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে রাশিয়া কেবল ইউক্রেন নয়, সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করছেন।
তিনি বলেন, অস্ত্রের বিরুদ্ধে অনেক কনভেনশন আছে, কিন্তু বৈশ্বিক খাদ্য ও এনার্জি সরবরাহকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার বিরুদ্ধে কোনো কনভেনশন নাই।
আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনে জোর প্রধানমন্ত্রীর : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনের ফাঁকে স্পেন এবং ইউরোপীয় কাউন্সিল আয়োজিত ‘টুওয়ার্ডস এ ফেয়ার ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল আর্কিটেকচার’ শীর্ষক একটি উচ্চপর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এই বিষয়ে কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাপী ক্রেডিট রেটিং সিস্টেম পর্যালোচনা করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, এটি বর্তমানে অনেক নি¤œ ও মধ্যম আয়ের দেশের জন্য তহবিলের সুবিধা সীমিত করেছে। তিনি বলেন, আমরা জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের সাথে একমত যে বৈশ্বিক ক্রেডিট রেটিং সিস্টেম অবশ্যই পর্যালোচনা করা উচিত। বর্তমান রেটিং সিস্টেম অনেক নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশের জন্য তহবিলের সুবিধাকে আরো সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, আমরা প্রায়ই আন্তর্জাতিক পাবলিক ফাইন্যান্সগুলোকে ব্যয়বহুল এবং নাগালের বাইরে দেখতে পাই। ঋণের ঝামেলা এড়াতে আমরা উচ্চসুদের ঋণ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি। বাংলাদেশ কখনই এর ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়নি এবং আমরা সেই রেকর্ড বজায় রাখার আশা করি।
আন্তর্জাতিক ফাইনান্সিয়াল-আর্কিটেকচারের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গ্লোবাল সাউথের প্রতিনিধিত্ব করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা স্বীকার করি যে আন্তর্জাতিক ফাইনান্সিয়াল-আর্কিটেকচারের জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু সংস্কারের প্রকৃতি ও পরিধির বিষয়ে এগ্রিমেন্টের ক্ষেত্রে এখনো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আর এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন।
এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। প্রথম প্রস্তাবে তিনি বলেন, এমডিবি, আইএফআই এবং বেসরকারি ঋণদাতা সংস্থাগুলোকে তাদের অগ্রাধিকারগুলো পুনরায় সাজাতে হবে এবং এসডিজি বাস্তবায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবেলার জন্য অতিরিক্ত তহবিল সংগ্রহ করতে হবে। দ্বিতীয়ত এবং তৃতীয় দফা সম্পর্কে তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য স্বল্প ব্যয়ে, রেয়াতি হারে তহবিলের পর্যাপ্ততা প্রয়োজন এবং পছন্দসই উচ্চমানের বিপুল পরিমাণে অনুদান এবং সমস্ত ঋণদানের উপকরণগুলোতে দুর্যোগের ধারা থাকতে হবে যাতে দুর্বল দেশগুলো সঙ্কটকালের ধাক্কা সামলাতে পারে। চতুর্থ দফা সম্পর্কে তিনি বলেন, ঋণদাতাদের মধ্যে স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে ন্যায্য ও কার্যকর ঋণ হিসেবে ত্রাণ ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পঞ্চম এবং শেষ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোটার পরিবর্তে এসডিআর ঋণের সীমা প্রয়োজন এবং সীমাবদ্ধতার ভিত্তিতে সহজ ঋণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হওয়া উচিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ দীর্ঘ দিন ধরে তার সুষ্ঠু সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্য সুনাম কুড়িয়েছে। তিনি বলেন, মহামারীর ঠিক আগে আমাদের অর্থনীতি ৮.১৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং জলবায়ু সঙ্কট আমাদের অর্থনীতিকে চাপের মধ্যে ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশ আইএমএফের সাথে ৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ প্যাকেজ নিয়ে আলোচনা করেছে। তিনি বলেন, আমরা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, লেনদেনে ভারসাম্য এবং আমাদের উন্নয়ন ব্যয় বজায় রাখার চেষ্টা করছি। তিনি বলেন, আমরা আমাদের দারিদ্র্যের হার ৪১.৯ শতাংশ থেকে ১৮.৭ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের মাত্রা ২৫.৫ শতাংশ থেকে ৫.৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছি।
বাইডেনের ভোজসভায় প্রধানমন্ত্রী : সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে নিউ ইয়র্কে আগত রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সম্মানে গতকাল সন্ধ্যায় মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্ট-এ ভোজসভার আয়োজন করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ভোজসভায় অন্যদের সাথে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যস্ত কর্মসূচি নিয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ সংবর্ধনার কথা সাংবাদিকদের জানান। প্রধানমন্ত্রীর কন্যা এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) থিম্যাটিক অ্যাম্বাসেডর সায়মা ওয়াজেদ এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সাথে ছিলেন। ভোজসভায় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সাথে কুশল বিনিময় করেন বলে জানান মোমেন।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির সম্মাননা : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ব্রাউন ইউনিভার্সিটি বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করেছে। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল তৈরির জন্য জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে তাকে এই বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ওয়ারেন অ্যালপার্ট মেডিক্যাল স্কুলের মেডিসিন অ্যান্ড বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের ডিন ডা: মুকেশ কে জৈন প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার অবস্থানস্থল দ্য লোটে নিউ ইয়র্ক হোটেলে প্রশংসাপত্রটি হস্তান্তর করেন।
প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি মো: নূরেএলাহি মিনা এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, ব্রাউনের ওয়ারেন অ্যালপার্ট মেডিক্যাল স্কুল কমিউনিটি ক্লিনিক মডেলের উদ্যোগ নেয়ার জন্য জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীকে তার স্বীকৃতির জন্য বিশেষ সম্মাননা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের সময়, ড. জৈন জনস্বাস্থ্য ও গবেষণার ক্ষেত্রে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের একটি সম্ভাব্য প্লাটফর্ম হিসেবে বাংলাদেশ-ব্রাউন বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন ইনিশিয়েটিভ সম্পর্কে আলোচনা করেন।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের পরীক্ষা করছে। ড. জৈন আরো বলেন, তারা ক্লিনিক থেকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী রোগীদের রেকর্ড রাখার জন্য বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিককে ইলেকট্রনিক ডেটা ম্যানেজমেন্ট চালু করতে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে পারে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটি গবেষণা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে একটি অংশীদারিত্ব গড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা