১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`
খেলাপি ঋণে উল্লম্ফন

তিন মাসে বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা

ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমছে
-

ব্যাংক খাতে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ১১ হাজার কোটি টাকা বেড়ে মার্চ শেষে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। তিন মাস আগে অর্থাৎ গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা এই অবস্থাকে অর্থনীতির জন্য অশনি সঙ্কেত হিসেবে বিবেচনা করছেন। তাদের মতে, ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়া, দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এ দশা হয়েছে। আর এটা চলতে থাকলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাবে। কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ হবে না। এতে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরো অনেক বেশি। ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমাফিক ঋণ নবায়ন করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিসহায়তায় ব্যাংকগুলো ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে অনেকটা স্বাধীন রয়েছে। তারা বলেন, অনেক বড় বড় শিল্প গ্রুপ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করছে না। আবার তা খেলাপি হিসেবেও দেখানো হচ্ছে না। বিশেষ ব্যবস্থায় তা নিয়মিত দেখানো হচ্ছে। আর এ কারণেই খেলাপি ঋণের বড় একটি অংশ আড়াল হয়ে যাচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফের হিসাবে খেলাপি ঋণ তিন লাখেরও বেশি। আইএমএফ বলছে, আদালতের স্থগিতাদেশ দেয়া খেলাপি ঋণ, ব্লক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত ঋণ এবং আদায় না হওয়া পুনঃতফসিলকৃত খেলাপি ঋণকেও এর মধ্যে হিসাব করেছে। খেলাপি ঋণ এভাবে বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের আয় থেকে বেশি হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। অনেক ব্যাংকের পক্ষে আয় দিয়েও এই প্রভিশনের সংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বেড়ে গেছে প্রভিশন ঘাটতি।

খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়া, দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এ দশা হয়েছে। আর এটা চলতে থাকলে কাক্সিক্ষত হারে জাতীয় প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। খেলাপি ঋণের এ উল্লম্ফনের বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নানাভাবে ঋণখেলাপিদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। তারা সুদের হারে ছাড় পাচ্ছে। ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। নানাভাবে ছাড় পাওয়ার কারণে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন তারা ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এভাবে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। এ খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় নগদ আদায় যেমন কমছে, তেমনি আমানত প্রবাহও কমে যাচ্ছে। প্রভাব পড়ছে বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর।

ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে চলছে বলে মনে করেন সাবেক এক ব্যাংকার। তিনি জানিয়েছেন, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে উদাসীনতার পরিচয় দেয়া হচ্ছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। নেই ব্যাংকিং খাত সংস্কারের কোনো ব্যবস্থা। উপরন্তু নানাভাবে ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়া হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে চলছে। আর এটা চাপানো হচ্ছে উদ্যোক্তা ও আমানতকারীদের ওপর। এক দিকে আমানতের সুদহার কমে যাচ্ছে। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ আমনতকারীরা। অন্য দিকে ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। এতে বিদেশী পণ্যের সাথে মূল্যের প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে দেশী পণ্য। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে মার খাচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। অন্য দিকে দেশের ব্যাংকিং খাতও দুর্বল হয়ে পড়ছে। বাড়ছে ঝুঁকির পরিমাণ। এভাবে চলতে থাকলে সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের ভাগ্য বরণ করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। এ থেকে উত্তরণের জন্য ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভালোভাবে ব্যাংকিং খাত সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জানুয়ারি-মার্চ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। ফলে গত মার্চ শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছরের মার্চে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো এখন নিজেই নিজেদের ঋণ পুনঃতফসিল করছে। ফলে ব্যাংক চাইলেই খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে। তাই খেলাপি ঋণের এ তথ্য প্রকৃত চিত্র নয়। বাস্তবে খেলাপি ঋণ আরো বেশি হতে পারে।

 


আরো সংবাদ



premium cement