২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রমজানেও আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ সীমিত রাখা হবে

-

গ্যাস সঙ্কটের কারণে প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না কোথাও। বিদ্যুৎকেন্দ্র, সারকারখানা বা আবাসিকে চাহিদানুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যােেচ্ছ না। এক ক্ষেত্রে গ্যাস কম দিয়ে অন্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনের নিরিখে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে রমজান, সেচ মৌসুম ও গ্রীষ্মকালে গ্যাস উৎপাদন, আমদানি ও বরাদ্দ বিবেচনায় নিয়ে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন-পেট্রোবাংলা। এ পরিকল্পনার মধ্যে রমজান সত্ত্বেও আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ সীমিত রাখা হবে। তবে এখানে অগ্রাধিকার দেয়া হবে বিদ্যুৎ ও শিল্পে গ্যাস সরবরাহকে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এমনিতে দীর্ঘ প্রায় দেড় দশক ধরে আবাসিকে নতুন করে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। আবাসিকে বিদ্যমান গ্যাস সরবরাহও ঠিকমতো দেয়া হচ্ছে না। নতুন করে সিদ্ধান্ত নেয়ায় আবাসিকে গ্যাস সঙ্কট আরো বেড়ে যাবে। আজ শুক্রবার থেকে রমজান শুরু। এ রমজানে রাজধানীবাসীর ভোগান্তি আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু মজুদ বাড়ছে না। নতুন নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার না হওয়ায় গ্যাসের বিদ্যমান মজুদও ফুরিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে চাহিদা মেটাতে উচ্চ মূল্যের জ্বালানি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে হচ্ছে। এতে বাড়ছে গ্যাসের গড় মূল্য। বেশি দামে আমদানি করে কম মূল্যে বিক্রি করায় ভর্তুকি বেড়ে যাচ্ছে। এ ভর্তুকি কমাতে এক দিকে যেমন গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে, অন্য দিকে ডলার সঙ্কটের কারণে বর্ধিতহারে গ্যাস আমদানি করা যাচ্ছে না। এতে বেড়ে গেছে ঘাটতি। এ ঘাটতি মেটাতে গ্যাসের রেশনিং করা হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চাহিদার ৪৭ শতাংশ এবং সারকারখানাগুলোর চাহিদার ৫৫ শতাংশ সরবরাহ করা গেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর গ্যাসের চাহিদার ২১৭ কোটি ৪০ লাখ ঘনফুটের বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ১০৩ কোটি ৩০ লাখ ঘনফুট। আর সারকারখানাগুলোতে ৩১ কোটি ৬০ লাখ ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ১৭ কোটি ৪০ লাখ ঘনফুট। আবাসিকে দীর্ঘ দিন ধরেই গ্যাস সঙ্কট রয়েছে। সামনে সেচ মৌসুম। সেচ কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং শিল্পে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে একটি পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে জ্বালানি বিভাগ থেকে। গতকাল গ্যাস সরবরাহে বিবেচ্য বিষয়ের একটি তালিকা দিয়েছে পেট্রোবাংলা। এর আগে গত বুধবার এ নিয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়। এতে বলা হয়, সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদার মৌসুমে সারকারখানায় গ্যাস সরবরাহ সীমিত রাখতে হবে। সিএনজি স্টেশন দিনে পাঁচ ঘণ্টা বন্ধ রাখার বিষয়টি নজরদারি করতে হবে। পেট্রোবাংলা বলছে, দেশে এখন দিনে গ্যাসের চাহিদা ৪০০ কোটি ঘনফুট। সর্বোচ্চ সরবরাহ করা হয় ৩০০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে দেশীয় উৎস থেকে আসে ২২৫ থেকে ২৩০ কোটি ঘনফুট। বাকিটা এলএনজি আমদানি করে মেটানো হয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় নিয়মিতই এক খাতে কমিয়ে আরেক খাতে সরবরাহ বাড়ানোর কাজটি করতে হয়। এতে আবাসিক গ্রাহকরা দিনের বড় একটা সময় গ্যাস পান না। একই সাথে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন অভিযান জোরদার, জ্বালানি-দক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে গ্যাস সরবরাহকে অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা জানান, গত দুই দশক ধরে গ্যাসের উৎপাদন বাড়েনি। নতুন নতুন গ্যাস উৎপাদনের জন্য তেমন কোনো ফলপ্রসূ উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বাড়তি চাহিদা মেটাতে বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্র থেকে বর্ধিত হারে গ্যাস উৎপাদন করতে হয়েছে। এতে ফুরিয়ে যাচ্ছে গ্যাসের মজুদ। এ সঙ্কট কাটাতে সরকার উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করছে। এতেই বেড়ে যাচ্ছে গ্যাসের ভর্তুকি।

জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে আবাসিক ও শিল্পে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। এর পরেও গ্যাসের চাহিদা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে গ্যাসের চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে ঘাটতি ছিল ৫০ কোটি ঘনফুট। এখন সরকারি হিসাবেই এ ঘাটতি ১০০ কোটি ঘনফুট ছেড়ে গেছে। পেট্রোবাংলার সূত্র বলছে, ২০১৪ সালের ১৪ জুন ঢাকার পাশের রূপগঞ্জে ছোট্ট একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। তারপর আর কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। আবিষ্কারের উদ্যোগও তেমন ছিল না। অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিকল্পনা পর্যায়েই আছে।
কিন্তু দেশে গ্যাসের চাহিদা বাড়লেও গ্যাসের মজুদ তেমন বাড়েনি। বরং মজুদ গ্যাস ব্যবহারের ফলে প্রতিনিয়তই তা কমে যাচ্ছে। নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হওয়ায় মজুদ দিন দিন কমে যাচ্ছে। কিন্তু গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গত ১০ বছরে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। বরং ঘাটতি পূরণে বিভিন্ন সময় কিছু কর্মসূচি নেয়া হলেও তা বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। এরপর বাপেক্সকে দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করানো হয়। তবে বাস্তবায়ন পর্যায়ে যাওয়ার আগেই সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতে দুই বছরের জন্য ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’ ধরনের কার্যক্রম নেয়া হয়। ওই কর্মসূচিও তেমন বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। আর এ কারণেই গ্যাস সঙ্কট বেড়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এ থেকে উত্তরণের একটাই পথ- আর তা হলো অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে হবে। এ জন্য ব্যাপক ভিত্তিতে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের অনুসন্ধান চালাতে হবে। তারা জানান, বাংলাদেশের সাগর বক্ষে গ্যাস প্রাপ্তির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে এখন বাংলাদেশের ২৬টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি অগভীর ও ১৩টি গভীর সমুদ্রে। বিদেশী কোম্পানিগুলো যাতে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আগ্রহী হয়, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে এ জন্য একটি তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে হবে। মোট কথা গ্যাস উত্তোলন নিয়ে ব্যাপক ভিত্তিতে উদ্যোগ নেয়া হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে গ্যাসের মজুদ ও উৎপাদন বেড়ে যাবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেন।


আরো সংবাদ



premium cement