২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

খোশ আমদেদ মাহে রমজান

-


মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অপার রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির অমিয় বারতা নিয়ে শুভাগমন করলো ১৪৪৪ হিজরির মাহে রমজানুল মোবারক। আজ রমজানের প্রথম দিবস। প্রতিদিন সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও কামাচার থেকে নিয়তসহকারে নিবৃত্ত থাকার মাসব্যাপী বিধানের জানান দিতে গতকাল বাংলাদেশের আকাশে উদিত হয়েছে নতুন চাঁদ। দিনের বেলা সিয়াম পালন ও রাতে তারাবিহ সালাতসহ বিভিন্ন ইবাদতে আত্মনিয়োগের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন আল্লাহর মুমিন বান্দারা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ঘোষিত পুরস্কারের আশায় মহান প্রভুর দরবারে সমর্পিত হওয়ার সূচনা হয়েছে গতকাল দিনশেষে। গতরাতে এশার সালাতের পর যথারীতি শুরু হয়েছে সালাতুত তারাবিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ।
সিয়াম সাধনার বিধান নিয়ে আগমন করা রমজানের নামকরণের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। অনেকে বলেছেন, এটি ‘রম্জ’ শব্দ হতে নিষ্পন্ন, যার অর্থ ভীষণ তাপ ও প্রচণ্ড গরম। যে বছর এই মাসের এই নাম রাখা হয়েছে সে বছর যেহেতু এই মাসটি এসেছিল প্রচণ্ড গরমের সময়, তাই এর নাম রাখা হয়েছে রমজান। অনেকের বক্তব্য, এই নামকরণের কারণ এটি গুনাহকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভষ্ম করে দেয়। আর অনেকে বলেছেন, রমজান আল্লাহ তাআলার সুমহান নামগুলোর একটি। সুতরাং ‘শাহরু রমজান’ এর অর্থ আল্লাহর মাস।


মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা মুয়াজ্জমা থেকে মদিনায় হিজরত করে যাওয়ার দ্বিতীয় বছরে রমজানের সিয়াম ফরজ হওয়ার আয়াত অবতীর্ণ হয়। ইরশাদ হয়, হে মুমিনরা, তোমাদের ওপর সিয়াম আবশ্যিক করা হলো, যেমন তা আবশ্যিক করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর- এই আশায় যে তোমরা মুত্তাকি হবে (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৩)।
এর পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম আশুরা এবং আইয়ামে বিজের রোজা রাখতেন বলে হাদিসের গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে। তবে এ ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে যে এই রোজা তখন ফরজ ছিল কি না। হানাফিরা বলেন, তখন এই রোজা ফরজ ছিল। শাফেয়ীদের মতে রমজানের রোজার পূর্বে কোনো রোজা ফরজ ছিল না। বরং আশুরা ইত্যাদির রোজা তখনও সুন্নত ছিল, এখনও সুন্নত। আবু দাউদ শরিফের একটি বর্ণনায় হানাফিদের অভিমতের সমর্থন পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার রোজা যারা রাখেনি, তাদের এটির কাজা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর কাজা আদায় করতে হয় ফরজ অথবা ওয়াজিবেরই। তবে যেহেতু রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরা ইত্যাদি রোজা ফরজ না হওয়ার ব্যাপারে উম্মতের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেহেতু উপরোক্ত মতপার্থক্যের কোনো প্রভাব এখন কোথাও প্রতিফলিত হবে না। এটি একটি তাত্ত্বিক ও বিদ্যায়তনিক বিষয়বস্তু হয়ে রয়েছে।


রমজান মাসের মাহাত্ম্য প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে বর্ণিত আছে- আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শয়তান ও দুষ্ট জিনদেরকে রমজান মাসের প্রথম রাতেই শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয়, এটির একটি দরজাও তখন আর খোলা হয় না; খুলে দেয়া হয় জান্নাতের দরজাগুলো, এটির একটি দরজাও তখন আর বন্ধ করা হয় না। একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেন- হে কল্যাণ অন্বেষণকারী! অগ্রসর হও। হে পাপে আগ্রহী, বিরত হও। আর বহু মানুষকে আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ থেকে এ মাসে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয়। প্রত্যেক রাতেই এরূপ হতে থাকে।


অনেক আলেম এটাকে প্রত্যক্ষ অর্থে প্রয়োগ করেছেন। অর্থাৎ, শয়তান ইত্যাদিকে মুক্ত থাকতেই দেয়া হয় না। এগুলোকে বন্দী করা হয়। প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ হজরত ইবনে মুনির ও কাজি ইয়াজ (রহ:) এই অভিমতের পক্ষপাতী। তবে হাদিসের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাকার মনীষী আল্লামা তুরপশতি (রহ:) প্রমুখ এটাকে রহমত নাজিল হওয়ার ইঙ্গিত বলে মন্তব্য করেছেন। তারা আলোচ্য হাদিসের মর্ম এই বলে বর্ণনা করেছেন যে, এই মাসে নেক কাজের সওয়াব বেশি লাভ হয়, গুনাহ মাফ করা হয়, অপরাধ ক্ষমা করা হয় ও শয়তানগুলোর প্রভাব হ্রাস পায়। প্রখ্যাত মুফাসসির ও হাদিসবেত্তা আল্লামা কুরতুবি (রহ:) এ দুটি বক্তব্যের মধ্য থেকে প্রথমটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।


তবে এখানে প্রশ্ন হয়, যদি শয়তানদের বন্দী করা হয় তাহলে এ মাসে মানুষের দ্বারা অপরাধ ও গুনাহের কাজ কিভাবে সংঘটিত হয়? বর্ণিত অর্থের দাবি তো এই মাসে কোনো ব্যক্তিই কোনো প্রকার গুনাহে লিপ্ত হবে না। আল্লামা কুরতুবি (রহ:) জবাব দিয়েছেন, আল্লাহর অবাধ্যতা ও গুনাহের কারণ শুধু শয়তান ও অবাধ্য জিনগুলোই নয়। গুনাহে লিপ্ত হওয়ার আরো অনেক কারণ আছে। যেমন, কুপ্রবৃত্তির তাড়না, মানবরূপী শয়তানের সংশ্রব, বদঅভ্যাস, ব্যক্তিজীবনের অনাচার ইত্যাদি। সুতরাং জিন শয়তানগুলোকে বন্দী করা হলে গুনাহের উপকরণ হ্রাস পায় বটে, তবে সম্পূর্ণ শেষ হয় না। তা ছাড়া যেহেতু এগারো মাস শয়তান মানুষের পেছনে লেগেই থাকে, তাই রমজানুল মোবারক মাসে এগুলো বন্দী হওয়া সত্ত্বেও তাদের তৎপরতার প্রভাব হ্রাস পেলেও অবশিষ্ট থাকে। যেমন, গরম লোহা আগুন থেকে বের করার পরও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত উত্তপ্ত থাকে। যদিও এর উত্তাপ আস্তে আস্তে কমতে থাকে।

 


আরো সংবাদ



premium cement