২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

প্রভাবশালী দেশকে কী বার্তা দিচ্ছে বিএনপি

নির্বাচন ইস্যু
-

নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে পুরোদমে মাঠে নামার আগে জোরেশোরে কূটনৈতিক তৎপরতাও চালাচ্ছে বিএনপি। দলটি সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারতসহ বেশ কিছু প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছে। এসব বৈঠকে মূলত বিএনপি আগামী নির্বাচন কেন নির্দলীয় সরকারের অধীনে হতে হবে এবং কেন এ দাবিতে সরকারবিরোধী দলগুলো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট বার্তা দেয়ার চেষ্টা করছে।

দলটির কূটনৈতিক সংযোগের সাথে জড়িত নেতারা মনে করছেন, মাঠের আন্দোলনের পাশাপাশি প্রভাবশালী দেশগুলোকে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবহিত করাও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের গণতন্ত্র, রাজনীতি ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গন সমানভাবে উদ্বিগ্ন। তারাও আগামীতে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক একটি জাতীয় নির্বাচন দেখতে চান। বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা গতকাল শুক্রবার বিকেলে আলাপকালে বলেন, কূটনীতিকদের মনোভাব বুঝা কঠিন। তারা শোনেন বেশি, বলেন কম। তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অন্তত চারটি পরাশক্তির প্রভাব দৃশ্যমান। এদের সবার এজেন্ডাও আবার এক নয়। বিএনপি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে রয়েছে। দেশের পরিস্থিতি বন্ধু দেশগুলোকে অবহিত করা এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেই পরিণত হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বিএনপির নেতাদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও অংশ নেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ইসলাম। নৈশভোজের আড়ালে বিএনপির পাঁচ নেতার সাথে ভারতের হাইকমিশনারের এই বৈঠক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহল রয়েছে।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দলটির নেতারা নৈশভোজের পাশাপাশি প্রায় ৩ ঘণ্টা হাইকমিশনারের সাথে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন। প্রণয় ভার্মা নির্বাচন ও আন্দোলন নিয়ে বিএনপির অবস্থান জানতে চাইলে নেতারা তা তুলে ধরেন। দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না জানিয়ে ভারতের হাইকমিশনারকে বিএনপির নেতারা বৈঠকে বলেন, ২০১৪ সালে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হয়েছে। বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে প্রহসনের সেই নির্বাচন বয়কট করেছে।

তারা বলেন, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমরা সংলাপে বসেছিলাম। তিনি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন কোনো মামলা-হামলা হবে না। কিন্তু সংলাপের পরদিন থেকেই মামলা-হামলা শুরু হয়। আমাদের প্রার্থীদের নির্বাচনের মাঠেই নামতে দেয়া হয়নি। শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে অনেককে। সিনিয়র নেতারাও আক্রমণ থেকে রক্ষা পাননি। আর নির্বাচন তারা আগের রাতেই করে ফেলেছে।


বিএনপির এক নেতা বৈঠকে এও বলেন, নির্বাচনের আগে ভারত সচিব পর্যায়ের একজনকে পাঠিয়ে কোনো দলের পক্ষে অবস্থান নিতে আমরা দেখেছি। যা এ দেশের জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। এ সময় নেতারা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে তোলার কথা বলেন।

হাইকমিশনার আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি জানায়, আন্দোলন চলছে। তাদের আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে জনগণ মাঠে নেমেছে। ১০ বিভাগে সরকারের সব বাধা পেরিয়ে লাখ লাখ মানুষ তাদের সমাবেশে অংশ নিয়েছে। একদিনের সমাবেশ তিন দিনে রূপ নিয়েছিল। ঢাকায় দলের মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ ৫০০ নেতাকে গ্রেফতার করা হলেও বিশাল গণসমাবেশ হয়েছে।

আন্দোলন কত দিন চলবে হাইকমিশনারের এমন প্রশ্নে বিএনপির নেতারা বলেন, দাবি আদায় না পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে।

ভারতের সাথে বিএনপির সম্পর্কের অবনতি কেন হয়েছে জানতে চাইলে বিএনপির নেতারা বলেছেন, বিএনপি সবসময়ই ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে বিশ্বাসী। কিন্তু ১০ ট্রাক অস্ত্র চালানের সাথে বিএনপিকে দায়ী করা হয়, এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ। বিএনপি সরকার এ ঘটনার সাথে জড়িত ধাকলে পুলিশ তখন কিভাবে সেই চালান আটক করেছে। এখন অনুপ চেটিয়াকে দিয়ে যেসব বানোয়াট কথা বলানো হচ্ছে, তা আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে হচ্ছে বলে বিএনপির নেতারা হাইকমিশনারকে জানান।
চীনের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে ভারতের হাইকমিশনারকে বিএনপি জানায়, চীনের সাথে বিএনপির স্বাভাবিক সম্পর্ক রয়েছে। তবে বর্তমান সরকার তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।

এর আগে গত সপ্তাহের শুরুতে আগামী নির্বাচন, মানবাধিকারসহ সমসাময়িক নানা পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিউয়নভুক্ত আট দেশের রাষ্ট্রদূতের সাথে দেড় ঘণ্টা বৈঠক করে বিএনপি। মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে দলের চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ওই বৈঠকে অংশ নেয়। বৈঠকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির নেতৃত্বে ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতরা উপস্থিত ছিলেন।

জানা গেছে, ওই বৈঠকেও বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়। একইসাথে কেন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না তাও নেতারা বিস্তারিত তুলে ধরেন। নেতারা ইইউ রাষ্ট্রদূতদের বলেন, বিগত দু’টি নির্বাচন জনগণের ভোটে হয়নি। সরকার জোর করে ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতায় টিকে আছে।

ওই বৈঠক শেষে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছিলেন, দেশের বর্তমান অবস্থা ও নির্বাচন পরিস্থিতি সারা বিশ্বের যারা গণতান্ত্রিক দেশ আছে সবাই নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের বর্তমান গণতান্ত্রিক অবস্থা কী, মানবাধিকার, আইনের শাসন শাসন, মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেমন, বিশেষ করে আগামী নির্বাচন নিয়ে যে শঙ্কা কাজ করছে, সেসব বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।

জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে বিএনপি। দলটির কূটনৈতিক উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অংশ ঢাকার দূতাবাসে নিয়মিত যাতায়াত করেন। একইসাথে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে তারা দূতাবাসকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে থাকেন। বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলেছেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান একদমই স্পষ্ট। তারা বাংলাদেশ শক্তিশালী গণতন্ত্র দেখতে চায়। আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে তাদের নানাবিধ উদ্যোগও রয়েছে।

গত কয়েক মাসে মার্কিন প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফরকেও বিএনপির নেতারা তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement