২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
আগামী নির্বাচনে আ’লীগের মনোনয়ন

কপাল পুড়ছে বিতর্কিত এমপি ও নেতাদের!

-

বিতর্কিত এমপি ও অজনপ্রিয় নেতাদের এবার মনোনয়ন না দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিএনপির অংশগ্রহণে আগামী সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলে মনে করছে দলটির হাইকমান্ড। এ কারণে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা ও এমপি দলীয় মনোনয়নের দৌড় থেকে ছিটকে পড়বেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়াও যারা গরিবের হক মেরে আখের গুছিয়েছেন, দুর্নীতি করে দুদকের জালে আটকা পড়েছেন, দলীয় টিকিট পেয়ে টানা তিনবার নির্বাচিত এমপি হয়েও তৃণমূল পর্যায়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারেননি তাদেরও মনোনয়ন না দেয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে হাইকমান্ড।

এক সময় কক্সবাজার-৪ আসনের এমপি আবদুর রহমান বদি, নোয়াখালী-৬ আসনের এমপি মোহাম্মদ আলী, নেত্রকোনা সদর আসনের এমপি আরিফ খান জয়সহ প্রায় এক ডজন প্রভাবশালী নেতা ও এমপি বেপরোয়া হয়ে পড়েছিলেন। তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দল ও সরকার বিব্রতবোধ করা ও অস্বস্তিতে পড়ায় সারা দেশের জনপ্রতিনিধি ও তৃণমূল নেতাদের অভিযোগ, গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট ও দলীয় রিপোর্ট আমলে নিয়ে গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েছিলেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এবারও বেশ কিছু এমপি ও নেতার নামে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। তাদের মধ্যে একজন ভোলা-৩ আসনের এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন। ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিসহ নানা ঘটনায় বিতর্কিত এমপি শাওনের বিরুদ্ধে এক ডজনেরও বেশি অভিযোগ আছে। ভুয়া প্রকল্প তৈরি করে ২০১০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ১৩ বছরে অর্ধশত কোটি আত্মসাৎ করার অভিযোগ আছে শাওন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাথমিক যাচাইয়ে এ অভিযোগের সত্যতা মিলেছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও শাওনের লোকজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাদের পিটিয়ে গুরুতর আহত করার অভিযোগ রয়েছে।

গত ৫ মার্চ থেকে ৭ মার্চ এই তিন দিনে মোট ১০ জনেরও বেশি নেতাকর্মীকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে শাওনের লোকজন, যাদের কেউ কেউ এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিছু দিন আগে একজন কলেজ অধ্যক্ষকে পেটানোর অভিযোগে রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন। তার এই কর্মকাণ্ড নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে জোরালো সমালোচনা হয়েছে। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনের এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল এবং দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এ ছাড়াও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের বিরুদ্ধে প্রার্থী দাঁড় করানো ও তার সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অভিযোগ আছে এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বিরুদ্ধে। সিরাজগঞ্জের এমপি মোমিন মণ্ডলের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া গত ১৯ মে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দীন কলেজের দুই সহকারী অধ্যাপককে পেটানোর অভিযোগ ওঠে ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনারের বিরুদ্ধে।

শিক্ষক পেটানোর ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় জেলাজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন কলেজ অধ্যক্ষ ড. মাহাবুবুর রহমান। দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ পিটিয়ে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে আলোচনায় আসেন বরগুনা-২ আসনের সরকারদলীয় এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমন। গত ২১ মে বরগুনার পাথরঘাটার হরিণঘাটা বাজারসংলগ্ন এলাকায় সালিসি বৈঠক ডেকে ফোরকান মিয়া নামে এক মাছ ব্যবসায়ীকে থাপ্পড় মারেন। এ ছাড়াও নোয়াখালী-৪ আসনের এমপি একরামুল করিম চৌধুরী, ঢাকা-৫ আসনের এমপি কাজী মনিরুল ইসলাম মনু, জামালপুর-৪ আসনের এমপি ডা: মুরাদ হাসান, রাজবাড়ী-১ ও ২ আসনের এমপিসহ প্রায় অর্ধশত এমপির নেতিবাচক কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে দলের ভেতরে-বাইরে।

তাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে জমা হচ্ছে অভিযোগের স্তূপ। বেশির ভাগ এমপির বিরুদ্ধে দলে ‘মাইম্যান’ তৈরি, নিজ এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তার, দলীয় নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে বিএনপি-জামায়াতকে মদদ দেয়া, বড় বড় দুর্নীতি ও ঘুষ কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত ও দুদকের খাতায় নাম লেখানো, স্থানীয় নির্বাচনে আর্থিক লেনদেন ও টিআর কাবিখা নিয়ে নয়ছয় করা, সেতু-কালভার্ট ও রাস্তা নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ টাকার নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যসহ সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এমন বেশ কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও তৃণমূল নেতাদের কাছ থেকে আসা লিখিত চিঠি ও অভ্যন্তরীণ বৈঠকের মাধ্যমে তৃণমূল নেতাদের অভিযোগগুলো আমলে নেয়া হচ্ছে। বিতর্কিত এমপিদের আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না দেয়ার ব্যাপারে দলীয় প্রধানেরও সতর্ক বার্তা রয়েছে। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর দলের প্রথম সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে গত ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের আগে ৮ বিভাগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক টিমের নেতারা দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার হাতে দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের ফিরিস্তি তুলে দেন। সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠকে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা নেতাদের উদ্দেশে বলেন, আমার কাছে অনেকেরই আমলনামা রয়েছে। আপনারাও খোঁজখবর নেন, আমাদের যারা এমপি রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোথায় কী দোষত্রুটি এবং দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের কী ধরনের অভিযোগ রয়েছে। কারণ নির্বাচন চ্যালিঞ্জং ইস্যু। কোনো বিতর্কিত কাউকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে না।

এ প্রসঙ্গে বুধবার সচিবালয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আমাদের দলে পরীক্ষিত নেতাকর্মী, যাদের জনপ্রিয়তা আছে তাদেরকেই মনোনয়ন দেয়া হবে। আওয়ামী লীগ একটা আদর্শিক দল, দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা কিংবা কর্মীকে বাদ দিয়ে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত আমলা কিংবা বড় ব্যবসায়ীদের আমরা নমিনেশন দিই না। তিনি আরো বলেন, অনেকে আওয়ামী লীগের নমিনেশন না পেয়ে বিএনপিতে গিয়েছিল এবং মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে নমিনেশন পেয়েছিল। পরে তারা মন্ত্রীও হয়েছিল। এ ধরনের প্র্যাকটিস বিএনপিই করে কারণ বিএনপি তো সৃষ্টিই হয়েছে ক্ষমতার হালুয়া রুটি বণ্টন করে রাজনীতির কাকদের নিয়ে।

দলের মনোনয়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগ একটি জনপ্রিয় ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। এই দলে রাজনীতি করতে হলে নিয়মের মধ্যে চলতে হয়; কারও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ কাম্য নয়। শুধু দলে কেন, জনগণের সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রেও এটি পরিমাপক হিসেবে দাঁড়ায়। তাই সব সময়েই দলের ভেতরে এসব বিষয় নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে দলীয় মনোনয়ন বোর্ড চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। তাই আগামী নির্বাচনে যারা তৃণমূলে জনপ্রিয়, সৎ যোগ্য ও দক্ষ তারাই দলের মনোনয়ন পাবে। বিতর্কিত এমপি ও নেতাদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যারা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে, দুর্নীতির সাথে জড়িত, অবৈধ ব্যবসা করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে, তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে যাদের সম্পর্ক নেই, জনবিচ্ছিন্ন তাদের কেউই আগামীতে মনোনয়ন পাবে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement