২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আগামী ছয় মাসেই ইউক্রেনের ভাগ্য নির্ধারিত হবে - সিআইএ প্রধান

-


ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণে আগামী ছয় মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক বিল বার্নস। গত বৃহস্পতিবার তিনি জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ভাষণে তিনি এই ভবিষ্যৎবাণী করেন। তিনি জানান, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আলোচনায় বসার জন্য মোটেই আগ্রহী নন। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রেই এই সঙ্কটের সমাধান খুঁজতে হবে। এ খবর দিয়েছে সিএনএন।
খবরে বলা হয়, বার্নস যুদ্ধের দুই রকম ফলাফলের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেন, হয় রাশিয়া ইউক্রেনের মধ্যে আরো বহুদূর এগিয়ে যাবে কিংবা সময় পরিবর্তন হয়ে ইউক্রেনের হাতে দখলকৃত অঞ্চল ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। ইউক্রেনের বিশাল সম্পদপূর্ণ অঞ্চল দখল করে নিয়েছে রাশিয়া। এই এলাকা দেশটির মোট আয়তনের ২০ শতাংশেরও বেশি। তবে রাশিয়ার এই দখলকে ‘অবৈধ’ বলে দাবি করেন সিআইএ প্রধান।
তিনি আরো বলেন, পুতিন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন ইউক্রেনকে মুচড়ে ফেলা কঠিন কিছু না এবং ভবিষ্যৎ তারই অনুকূলে। ইউরোপে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলে কিংবা যুক্তরাষ্ট্র বিভ্রান্ত হয়ে পড়লে তার অভিযান সফল হতে সাহায্য করবে।
তবে বার্নস বিশ্বাস করেন, রাশিয়ার এই হিসাবে ভুল রয়েছে। গত নভেম্বর মাসে তুরস্কে রাশিয়ার গোয়েন্দা প্রধান সের্গেই নারিশকিনের মুখোমুখি হয়েছিলেন বার্নস। সেখানে তিনি নারিশকিনকে সাবধান করে জানিয়েছেন, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আক্রমণের মতো, রাশিয়ার এই হিসাবেও গরমিল রয়েছে।
তিনি বলেন, আমি মনে করি যা হতে চলেছে তা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আলোচনায় বসতে আগ্রহী হবেন- এমনটি আমাদের হিসাবের মধ্যে নেই। ফলে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, আগামী ছয় মাসে মূল বিষয়টি ঘটবে যুদ্ধক্ষেত্রেই।


বার্নস আরো বলেন, আমার ধারণা, পুতিন এখন দৃঢ়ভাবেই মনে করছেন যে, তিনি সময়কে তার অনুকূলে কাজে লাগাতে পারেন। তাই যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তন আগামী ছয় মাসে ঘটবে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে ‘পুতিনের ঔদ্ধত্য খর্ব’ হতে পারে উল্লেখ করে বার্নস বলেন, এটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, তিনি (পুতিন) ইউক্রেইনে আর অগ্রসর হতে পারবে না কেবল তাই নয়, বরং একটি একটি করে মাস অতিবাহিত হতে থাকার সাথে সাথে এ পর্যন্ত তার অবৈধভাবে দখল করে নেয়া অঞ্চলগুলো হারানোর ঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে যাবে। যুদ্ধের এই পরবর্তী অধ্যায় পুরোপুরি গরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে বলেই আমি মনে করি, বলেন তিনি।
বার্নস আরো বলেন, পুতিন বিশ্বাস করেন, ইউরোপে রাজনৈতিক অবসাদ দেখা দিলে কিংবা যুক্তরাষ্ট্র বিভ্রান্ত হয়ে পড়লে তিনি ইউক্রেনকে মুচড়ে ফেলতে পারবেন বা তার সেনাবাহিনী অভিযান সফল করার নতুন একটি সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম দিকে ইউক্রেনের খেরসন, দনেস্ক, লুহানস্ক, খারকিভসহ বেশ কিছু অঞ্চলের দখল নিয়েছিল রুশ বাহিনী। পরে খারকিভ ও খেরসনের একাংশ পুনরুদ্ধার করে ইউক্রেনীয় সেনারা। ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে পশ্চিমা অস্ত্রের সহায়তায় পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনীয় সেনারা।


নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করছে রাশিয়ার পরাজয়
এ দিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতার ওপরই রাশিয়ার পরাজয় নির্ভর করছে। দেশটির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়াতে মস্কো যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, সেগুলো প্রতিহত করার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই এ নিষেধাজ্ঞাগুলো সফলতা পাবে।
বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেইনের সাথে এক সংবাদ সম্মেলনে জেলেনস্কি বলেন, নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর জন্য রাশিয়ার ক্ষমতা কমানোর কাজটি যত দ্রুত ও ভালোভাবে সম্পন্ন করা হবে, রাশিয়া পরাজয়ের ততটা কাছাকাছি পৌঁছাবে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ১০তম নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ নিয়ে আলোচনার বিষয়ে জেলেনস্কি অভিযোগ করেন, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের গতি কমিয়ে দিয়েছে ইউরোপ। এ অবস্থায় পরিস্থিতি সংশোধন করা গুরুত্বপূর্ণ।


জেলেনস্কি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সহযোগিতা জোরদার করার অর্থ হচ্ছে মুক্ত ইউরোপে মুক্ত মানুষের জীবন রক্ষার জন্য প্যান-ইউরোপীয় সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করা। আর একটি শান্তিপূর্ণ ইউরোপের স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব শুধুমাত্র ইউক্রেনের মাধ্যমে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে।
একপর্যায়ে জেলেনস্কি জোর দিয়ে বলেন, ইইউতে ইউক্রেনের সদস্যপদ তার জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি তাদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা। তিনি দাবি করেন, যুদ্ধের ময়দানে ইউক্রেন সেই মূল্যবোধকে রক্ষা করে, যার মাধ্যমে ইউরোপ ঐক্যবদ্ধ ও একত্র হয়ে থাকে।
জেলেনস্কি বলেন, ইউক্রেন ও ইউরোপের মধ্যে বৃহত্তর মিলনের প্রতিটি পদক্ষেপ ইউক্রেনের জনগণকে অনুপ্রাণিত করে। কারণ শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায় না, এর জন্য বিশ্বাস থাকাও গুরুত্বপূর্ণ। গত জুনে ইউক্রেনকে ইইউর সদস্যপদ পাওয়ার ব্যাপারে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল।
শুক্রবার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে ২৪তম ইইউ-ইউক্রেন শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে অংশ নিতে বৃহস্পতিবার ইইউ কমিশনারদের একটি দলের সাথে কিয়েভে যান ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেইন। কিয়েভের কর্মকর্তারা আশা করছেন, এ সম্মেলনের মাধ্যমে ২৭ সদস্যের ইইউ ব্লকের পূর্ণ সদস্য হওয়ার জন্য তাদের বিডকে শক্তিশালী করবে।


ফের জার্মান ট্যাংকের মুখোমুখি রাশিয়া : পুতিন
আমরা আমাদের ট্যাংক তাদের সীমান্তে পাঠাচ্ছি না, কিন্তু আমাদের তো জবাব দিতেই হবে। সেই জবাব কেবল সাঁজোয়া অস্ত্রশস্ত্রে হবে না। সবারই সেটা বোঝা উচিত, বলেছেন ৭০ বছর বয়সী রুশ নেতা।
স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধের সমাপ্তির ৮০ বছর পূর্তিতে দেওয়া ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা অভিযানের সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েতের লড়াইয়ের তুলনা টেনেছেন। ইউক্রেনে ট্যাংক পাঠানোর জার্মান সিদ্ধান্তকে ইঙ্গিত করে পুতিন বলেছেন, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
তিনি বলেছেন, এটা অবিশ্বাস্য, কিন্তু সত্য। আমরা ফের জার্মান লেপার্ড ট্যাংকের হুমকির মুখোমুখি।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর পর যে পশ্চিমা দেশগুলো কিয়েভকে নানাভাবে সহায়তা করছে জার্মানি তার অন্যতম। স্তালিনগ্রাদের এখনকার নাম ভলগোগ্রাদ, সেখানে দেয়া ভাষণে পুতিন ইউক্রেনে প্রয়োজনে প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্রের বাইরে অন্য কিছু ব্যবহারেরও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, যারা রাশিয়াকে যুদ্ধে হারানোর খোয়াব দেখছেন, তারা বুঝতে পারছেন না। রাশিয়ার সাথে অত্যাধুনিক যুদ্ধ তাদের জন্য কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে। আমরা আমাদের ট্যাংক তাদের সীমান্তে পাঠাচ্ছি না, কিন্তু আমাদের তো জবাব দিতেই হবে। সেই জবাব কেবল সাঁজোয়া অস্ত্রশস্ত্রে হবে না। সবারই সেটা বোঝা উচিত ।


এর মাধ্যমে পুতিন আদতে কী বুঝিয়েছেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলতে রাজি হননি ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো সম্মিলিতভাবে যত নতুন অস্ত্র পাঠাবে, রাশিয়াও তার প্রতিক্রিয়া দেখানোর সম্ভাবনাকে আরো বেশি করে কাজে লাগাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্তালিনগ্রাদ লড়াইয়ের সমাপ্তির বর্ষপূর্তি উদযাপনে বৃহস্পতিবার ভলগোগ্রাদে যান পুতিন। স্তালিনগ্রাদের ওই যুদ্ধে প্রায় ৯১ হাজার জার্মান সেনা রুশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই ফ্রন্টের লড়াইয়ে ১০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আর কোনো ফ্রন্ট এত প্রাণহানি দেখেনি। বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এক দিনের জন্য ভলগোগ্রাদ তার আগের নাম স্তালিনগ্রাদ ফিরে পেয়েছিল; দিনকয়েক আগে সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক নেতা জোসেফ স্তালিনের বিশাল মূর্তিও উন্মোচিত হয়েছে। ১৯২৪ সাল থেকে ১৯৫৩ সালে মৃত্যু পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে থাকা স্তালিনের শাসনামলেই ১৯৩২-৩৩ সালে ইউক্রেনে একটি দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। ওই দুর্ভিক্ষে আনুমানিক ৫০ লাখ লোক মারা পড়েছিল বলে অনেকের অনুমান; বুলগেরিয়ায় সম্প্রতি ওই দুর্ভিক্ষ গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর পর থেকেই পুতিন বলছেন, তার অভিযান হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও নাৎসিদের বিরুদ্ধে, যারা কিয়েভ সরকারের নেতৃত্বেও আছে। ভলগোগ্রাদে দেয়া ভাষণেও তার কণ্ঠে পাওয়া যায় একই সুর।


তিনি বলেছেন, “এখন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা দেখছি নাৎসিবাদী মতবাদ, যা এরইমধ্যে আধুনিক ছদ্মবেশে, আধুনিক অভিব্যক্তি নিয়ে হাজির হয়েছে, ফের আমাদের দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরাসরি হুমকি তৈরি করছে। বারবার, প্রতিবার আমাদেরকে সম্মিলিত পশ্চিমের আগ্রাসন প্রতিহত করতে হচ্ছে ।”
রুশ প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, রাশিয়া ফের জার্মান ট্যাংকের হুমকির সম্মুখীন হলেও হুমকি হওয়া প্রতিটি দেশের জন্য উপযুক্ত জবাব মস্কোর হাতে আছে। বার্লিন ইউক্রেনে ১৪টি লেপার্ড ট্যাংক পাঠাতে রাজি হওয়ার পর রুশ কোম্পানি ফোরেস রাশিয়ার কোনো সৈন্য যদি লেপার্ড ট্যাংক নষ্ট বা জব্দ করতে পারে, তাহলে তাকে ৫০ লাখ রুবল (৫৮ হাজার ২৫০ ইউরো) পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পুতিন এদিন স্তালিনগ্রাদের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকা সোভিয়েত মার্শালের কবরে ফুল দিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন; পরে তিনি স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে অংশ নেয়া সেনাদের মূল স্মৃতিসৌধেও যান, তিনি সেখানে যুদ্ধে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু সময় নীরবে কাটান। বৃহস্পতিবার ভলগোগ্রাদে হওয়া সামরিক কুচকাওয়াজ দেখতে শহরটির লাখো বাসিন্দার ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। কুচকাওয়াজে আকাশে সামরিক বিমানগুলোর গর্জন শোনা গেছে, অত্যাধুনিক বিভিন্ন ট্যাংকের পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অনেক ট্যাংকও শহরটির কেন্দ্রস্থলের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেছে। এ দিনের কুচকাওয়াজে অংশ নেয়া অনেক যানেই দেখা গেছে ‘জেড’ চিহ্ন, যা এরই মধ্যে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
(আরো খবর ৫ম পৃষ্ঠায়)

 


আরো সংবাদ



premium cement