২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
সরকারের এ সিদ্ধান্ত গণবিরোধী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ : মির্জা ফখরুল

আবারো বাড়ল বিদ্যুতের দাম

গ্যাস-বিদ্যুতের দাম তিন সপ্তাহে তিন দফা বৃদ্ধিতে দিশেহারা গ্রাহক ও শিল্প উদ্যোক্তারা
-

আবারো বাড়ল বিদ্যুতের দাম। এবার গ্রাহক পর্যায়ে ৫.০৮ এবং পাইকারি পর্যায়ে ৮.১০ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। সরকারের নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানো সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন গতকাল মঙ্গলবার জারি করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে গত তিন সপ্তাহের মধ্যে তিন দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। এর আগে এতো অল্প সময়ের ব্যবধানে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে দিশেহারা গ্রাহক ও শিল্প উদ্যোক্তারা। সব মিলিয়ে সরকার গত ১৪ বছরে ১১ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম পুনরায় বাড়ানোর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সরকারের ব্যর্থতা, দুর্নীতি, লুটপাট, অব্যবস্থাপনা ও ভ্রান্তনীতির কারণে এমনিতেই জনগণ চরম দুর্ভোগে রয়েছে। এর মধ্যে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি সরকারের গণবিরোধী, তুঘলকী ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। মাত্র ১৯ দিনের ব্যবধানে খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে দাম বৃদ্ধি সরকারের গণবিরোধী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে প্রতি জিনিসের দাম আবারো বৃদ্ধি পাবে। এই বোঝা জনগণ আর সহ্য করতে পারবে না।
শিল্প উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, কয়েক দিন আগে অর্থাৎ ১৮ জানুয়ারি শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে পৌনে ২০০ শতাংশ। ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছিল ৫ শতাংশ। আবার গতকাল গ্রাহকপর্যায়ে ৫.০৮ শতাংশ ও পাইকারি পর্যায়ে ৮.১০ শতাংশ বাড়ানোর ফলে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাবে। এতে রফতানি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি স্থানীয় বাজারেও পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাবে। আর গ্রাহকদের নাভিশ্বাস অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তারা ব্যয় সমন্বয় করার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। এ ছাড়া আগে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় কৃষি সেচ এবং হতদরিদ্র গ্রাহকদের বিশেষ ছাড় দেয়ার রেওয়াজ ছিল। তুলনামূলক ধনিক শ্রেণীর ভোক্তাদের দাম বাড়িয়ে ঘাটতি মেটানো হতো, এখন আর কিছুই মানা হচ্ছে না। এখন আর ধনী গরিব ক্ষুদ্র শিল্প, বৃহৎ শিল্প, রাস্তার পান দোকান, ভিক্ষুক কোনো কিছুই মানা হচ্ছে না। সব কিছু মিলিয়ে একাকার করে ফেলা হচ্ছে নির্বাহী আদেশে। এতে সামাজিক অস্থিরতার শঙ্কা করছেন জ্বালানি সংশ্লিষ্টরা।
নতুন মূল্য অনুযায়ী গ্রাহক পর্যায়ে সবচেয়ে কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের জন্য আগের চেয়ে ইউনিট প্রতি ২০ পয়সা বেড়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে এ দাম ৩ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ১৪ পয়সা করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩ এর ধারা ৩৪ক-তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ভর্তুকি সমন্বয়ের লক্ষ্যে ১২ জানুয়ারিতে জারি করা প্রজ্ঞাপন সংশোধন করা হলো।
আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি ৩ টাকা ৯৪ পয়সা থেকে ৪ টাকা ১৪ পয়সা, শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৪ টাকা ৬২ পয়সা, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ১ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৩১ পয়সা করা হয়েছে। আর ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৬২ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে ৬ টাকা ৯৯ পয়সাা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ১০ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৯৬ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১২ টাকা ৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ৬৩ পয়সা করা হয়েছে। এ ছাড়া পাইকারী পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্য ৬ টাকা ২০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৭০ পয়সা করা হয়েছে।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেছেন, বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম যে হারে বাড়ানো হয়েছে, তার কোনোই যৌক্তিকতা নেই। আমরা আগেও বলেছি এখনো বলছি দাম না বাড়িয়েও সামাল দেয়ার অনেক বিকল্প ছিল। অনেকগুলো জায়গায় অপচয় রয়েছে, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় চুক্তি করা হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) যেসব প্রক্রিয়ায় দাম বাড়ানো হতো, সেখানে নানারকম অসঙ্গতিগুলো চিহ্নিত হতো। সব ক্ষেত্রে যে প্রতিপালন করা যেতে সেটা বলব না, তবে কিছুটা উন্নতি হচ্ছিল। সমাজের পিছিয়ে থাকা বিপুল জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করার চেষ্টা থাকত। মূল্যহারের অভিঘাত থেকে হতদরিদ্র গ্রাহক, গ্রামের পান-বিড়ির দোকান, কৃষি সেচকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা হতো। একজন পান দোকানি আর বসুন্ধরা সিটির দোকানির বিদ্যুতের বিল সমান হতে পারে না। সেসব জায়গা দেখে রাখার চেষ্টা হতো। এখন সেসব চর্চা বন্ধ করে দেয়া হলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। বিইআরসিকে এখন ক্লিনিক্যালি ডেড বলা যায়। এর কুফল অনেক ভয়াবহ হবে। তিনি আরো বলেন, যে হারে দাম বাড়ানো হচ্ছে এর ফল উল্টো হবে। সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর কৌশল, হিতে বিপরীত হতে পারে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম যত বাড়বে, ততো ভোগ ব্যয় কমবে। বাজারে পণ্য বিক্রি কমে যাবে, এতে কমে আসবে সরবরাহ। কমে যাবে ভ্যাট-ট্যাক্স থেকে আয়।
বাংলাদেশ স্টীল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টীল মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানান, চলমান সঙ্কটের মধ্যে কী কারণে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে দফায় দফায় গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। গত ১৮ জানুয়ারি শিল্পে গ্যাসের দাম দাম দ্বিগুণ বাড়ানো হয়। ১২ জানুয়ারি গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ৫ শতাংশ। আবার গতকাল এক সাথে গ্রাহক ও পাইকারি উভয় খাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। তিনি জানান, এমনিতেই গত ৬ মাস যাবত এ শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলা যাচ্ছে না, এর আগে বিদ্যুৎ স্বল্পতা ছিল, এরপর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো, বাড়ানো হলো গ্যাসের দাম। এতে এ খাতের শিল্পগুলোতে এমনিতেই ত্রাহি অবস্থা। এর ওপর আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। সব মিলে গত তিন সপ্তাহে তিন দফায় দাম বাড়ানোর ফলে প্রতি টন রডের উৎপাদন খরচ বিদ্যুৎ গ্যাস মিলে দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। এখন যেখানে প্রতি টন রড উৎপাদন করতে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন হয়, এখন তা দ্বিগুণ অর্থাৎ ২০ হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা হবে। সব মিলে টন প্রতি উৎপাদন ব্যয় এক লাখ টাকা ছেড়ে যাবে। এতো দাম দিয়ে আমাদের দেশে মানুষের বাড়ি-ঘর নির্মাণ করার সক্ষমতা আছে কি না তা ভাবার বিষয়। তিনি বলেন, গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানোর ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ও বাড়বে। ফলে বাড়বে বিদ্যুতের দাম। এমনি পরিস্থিতিতে এ শিল্প টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়বে। আর তাহলে এ শিল্পের সাথে জড়িত লাখ লাখ কর্মক্ষম শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। তিনি বলেন, গ্যাস চুরি বন্ধ করা হলে ও অপচয় রোধ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না।


আরো সংবাদ



premium cement