২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দুর্নীতি ব্যবসায় প্রধান বাধা

-


সিপিডির জরিপ
-অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি মূল্যস্ফীতি ও ঋণ সমস্যা
-রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মদদে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে

বাংলাদেশে ব্যবসায় বড় বাধা দুর্নীতি। এটি দীর্ঘ সময় ধরে আছে। তার সাথে নতুন করে বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, ঋণপ্রাপ্তির অপর্যাপ্ততা ও অদক্ষ প্রশাসন। এসব সমস্যার সাথে সাম্প্রতিককালের উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট ও অস্থায়ী নীতি ব্যবসার পরিবেশকে আরো জটিল করে তুলেছে বলে মনে করছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি ও ঋণ সমস্যাকে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। বাড়ছে মাফিয়া চক্রও। এটি বাড়ছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মদদে বা ছত্রছায়ায়। সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাড়ছে। সামনে জাতীয় নির্বাচনের কারণে এটি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে বলে সিপিডির জরিপে প্রকাশ পেয়েছে।


রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ সিপিডির কার্যালয়ে গতকাল মিডিয়া ব্রিফিংয়ে জরিপের তথ্য তুলে ধরেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সঞ্চালনায় ছিলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের কৃষি, উৎপাদন ও সেবা খাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৭৪ জন পদস্থ কর্মকর্তা গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাইয়ে করা এ মতামত জরিপে অংশ নেন। সে হিসেবে এটি জাতীয় প্রতিনিধিত্বশীল জরিপ নয়।
দেশে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসার পরিবেশ আরো খারাপ হয়েছে জানিয়ে ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বেসরকারি খাতে সুশাসন, নীতিশাস্ত্রের অভাব এবং দুর্বল তদারকির কারণে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অবনতি হয়েছে। আর গত ২০২১ সালের থেকে ২০২২ সালে ব্যবসার পরিবেশ দুর্বল ছিল। কর কাঠামোতে এখনো ভারসাম্য আনা যায়নি। সড়ক, রেল, নৌপথে অনেক অবকাঠামো মানসম্মত নয়।


সিডিপি বলছে, ব্যবসায়ীরা বলছেন বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। এই মানিলন্ডারিংসংক্রান্ত সরকারি পদক্ষেপ অত্যন্ত বেশি অদক্ষ। তাদের মতামত প্রকাশ করেছে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি বড় অংশ অনথিভুক্ত এবং অনিবন্ধিত।
জরিপের অংশ নেয়া দু-তৃতীয়াংশ বা ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ কর্মকর্তা দুর্নীতিকে ব্যবসার বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন। কোনো কোনো জায়গায় দুর্নীতি হচ্ছে, সেটিও জরিপে উঠে এসেছে। ৬৪ শতাংশ কর্মকর্তা কর প্রদানে, ৫৪ শতাংশ ব্যবসায়িক লাইসেন্স নিতে, ৪৯ শতাংশ গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ নিতে এবং ৭৫ শতাংশ কর্মকর্তা আমদানি-রফতানিতে দুর্নীতির কথা বলেছেন। এ ছাড়া ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ দুর্নীতির পাশাপাশি ব্যবসার জন্য দুর্বল অবকাঠামো, ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ ব্যাংকঋণের অপর্যাপ্ততা ও অদক্ষ প্রশাসন, ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা, ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ নীতি ধারাবাহিকতার অভাব, ২৬ দশমিক ২ শতাংশ জটিল করব্যবস্থা ও উচ্চ করহার, ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ দুর্বল নীতি-নৈতিকতা ও সরকারে স্থিতিশীলতার অভাব, ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ অপরাধ ও উদ্ভাবনে অপর্যাপ্ত সক্ষমতা এবং ১০ দশমিক ৮ শতাংশ কর্মকর্তা শ্রমসংক্রান্ত নিয়মনীতির সীমাবদ্ধতাকে সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন।


সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশের আর্থিক খাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত মেনে চলার অংশ হিসেবে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন, ঋণে সুদহারের সীমা তুলে নেয়া, বকেয়া ঋণে স্বচ্ছতা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির (আইডিআরএ) কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে ব্যবসায় মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কট ও অস্থিতিশীল নীতির মতো নতুন চ্যালেঞ্জ মাথাচাড়া দিয়েছে জানিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন ও সুদহারের সীমা উন্মুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।
জরিপে সিপিডি বলছে, নন ট্যারিফ বাধা এখনো আমাদের জন্য সমস্যা। সঠিক অবকাঠামোর অভাবে বিদেশী বিনিয়োগ গত ২০২১ সালে আকৃষ্ট করেনি। এখনো করছে না। অবকাঠামো খাতে সরকার অর্থ ব্যয় করছে, প্রকল্প করছে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা তার সুফল পাচ্ছে না। বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে। সেখানে স্বজনপ্রীতি বেশি।


ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দুর্নীতির কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। সেবার মূল্যও বাড়ছে। এ বাড়তি মূল্যের ঘানি সাধারণ মানুষকেই টানতে হয়। নানা স্তরের দুর্নীতি ব্যবসার পরিবেশ ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তিনি বলেন, শুধু ডলার সঙ্কট নয়, আর্থিক সঙ্কুলানের অবস্থাও রয়েছে। আর্থিক টানাটানি রয়েছে। প্রকল্পের ব্যাপারে তিনি বলেন, যেসব প্রকল্প ৯০-৯৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে, সেগুলোকে দ্রুত শেষ করা দরকার। আর যেগুলোর কাজ ৫ থেকে ১০ শতাংশ হয়েছে সেসব প্রকল্প স্থগিত রাখা উচিত। তবে শ্রমঘন প্রকল্প দ্রুত সম্পন্ন করা দরকার। তিনি বলেন, ঢালাওভাবে ভর্তুকি সম্পদের অপচয় বৃদ্ধি করে। তাই এটি আমরা চাই না। তবে খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কৃষিতে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement