২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি প্রদানে হিমশিম খাচ্ছে সরকার

এক মাসেই দিতে হয়েছে ৩,৯৩৬ কোটি টাকা
-

দেশের বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির অর্থ প্রদানে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, বিদ্যুৎ বিভাগের চাহিদামাফিক ভর্তুকির অর্থ প্রদান করা সম্ভবতো হচ্ছেই না, উপরন্তু এক বছরের বাজেট থেকে পূর্ববর্তী অর্থবছরের ভর্তুকির টাকা দিতে হচ্ছে। এরপরও ভর্তুকি প্রদানে ৯ মাস পিছিয়ে আছে অর্থ বিভাগ।

সর্বশেষ গত বছরের (২০২২) এপ্রিল মাসের ভর্তুকির অর্থ মাত্র চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দেয়া সম্ভব হয়েছে। এই অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। তাও আবার একবারে দেয়া সম্ভব হয়নি। তিন কিস্তিতে সেটা দেয়া হয়েছে। প্রথম কিস্তিতে দেয়া হয় দুই হাজার কোটি টাকা। দ্বিতীয় কিস্তিতে আরো এক হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ দেয়া হয়েছে ৯৩৬ কোটি টাকা। ভর্তুকি অর্থ হ্রাসে সরকার শিগগিরই বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত বাজেটে আরো তিন হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি করে ভর্তুকির পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তারপরও এই সীমায় ভর্তুকি বেঁধে রাখা সম্ভব হয়নি। অর্থবছরের ১০ মাসেই (জুলাই-এপিল) বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দেয়া লাগছে ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বাকি দুই মাসে ভর্তুকির অর্থ বেড়ে ৭ হাজার কোটি টাকায় উত্তীর্ণ হতে পারে বলে সূত্র জানায়।

জানা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ থেকে গত অর্থবছরের কয়েক মাসের ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে। প্রতি তিন মাস অন্তর বিউবোকে ভর্তুকির অর্থ প্রদান করে থাকে অর্থ বিভাগ। গত ১১ বছরের শুধু বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে হয়েছে প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা। এর বেশির ভাগই বেসরকারি খাতে তৈরি হওয়া ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দেয়া হয়েছে। চলতি বছরের বিউবোর পক্ষ থেকে ভর্তুকি খাতে ৩২ হাজার ৫০০ টাকা অতিরিক্ত চাওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে ফার্নেস অয়েলের দাম এখনো অনেক বেশি। আর এই ফার্নেস ওয়েলই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত দামে ফার্নেস অয়েল কেনা হলেও সরকার কম দামে তা বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের কাছে বিক্রি করছে। অন্য দিকে, বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে ভর্তুকিও সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি ক্রমে বেড়েই চলেছে। ২০১০ সাল থেকে ভর্তুকি বিদ্যুৎ খাত লোকসানের দিকে চলতে থাকে। একই সাথে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে তাদের পেছনেও ভর্তুকির একটি বিশাল ব্যয় করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, ভর্তুকির চাপ সামলাতে পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম শতকরা ৫ ভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর কোনো প্রস্তাব দেয়া হয়নি। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন খুচরা পর্যায়েও দাম বাড়বে। কারণ বিপণন কোম্পানিগুলো বাড়তি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করবে তা হয় না। গত ১১ বছরে বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে ১১৬ ভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ পর্যায়ে গ্রাহক পর্যায়ে বেড়েছে ৯০ শতাংশ। বর্তমানে পাইকারি বিদ্যুতের দাম কিলোওয়াট ঘণ্টা ৫ টাকা ১৭ পয়সা। সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে আরো ৩ টাকা ৩৯ পয়সা। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও উৎপাদনক্ষমতা নিয়ে বাংলাদেশ নতুন সঙ্কটে পড়েছে। এর জন্য প্রধানত সঠিক পরিকল্পনা না নেয়াকে দায়ী করেছে বিশ্লেষকরা।

দেশে এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে ১৫২টি। সাধারণভাবে অর্ধেক বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে আছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিস’ (আইইইএফএ) ২০২০ সালে এক প্রতিবেদনে জানায়, দেশে ৫৭ শতাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেয়া হয়। তবে এখন এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় তেলভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বড় একটি অংশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে শীতেও করতে হচ্ছে লোডশেডিং। যেমন শীতকালে জানুয়ারি মাসে দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১০ হাজার মেগাওয়াটের কিছু বেশি। কিন্তু সরবরাহ করা যাচ্ছে ৯ হাজার থেকে সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াট। ফলে করা হচ্ছে লোডশেডিং। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে কয়লার অভাবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে কোনো বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হচ্ছে না। জানা গেছে, আশু ব্যবস্থা নেয়া না হলে আগামী গরম মওসুমে বিদ্যুৎপরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।

 


আরো সংবাদ



premium cement