১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিএনপির আন্দোলনে কি গণ-অভ্যুত্থান হবে?

বিবিসির বিশ্লেষণ
-


নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি। একটানা ১০টি বিভাগীয় সমাবেশের পর বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ধারাবাহিকভাবে সরকারবিরোধী নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে গণ-অবস্থান, গণ-মিছিল এবং পদযাত্রা। বিএনপি ‘গণ-অভ্যুত্থান’ সৃষ্টি করে সরকারের পতন ঘটাতে চাইছে, আর আওয়ামী লীগ বলছে বিএনপির সেই ‘সক্ষমতাই’ নেই। এজন্য সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যুগপৎ আন্দোলন করছে বিএনপি।
বিএনপির চলমান কর্মসূচি আর অতীতের আন্দোলন মূল্যায়ন করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন এভাবে গণ-আন্দোলন সৃষ্টি এবং বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সফল হওয়া কঠিন। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তারা। বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম উপদেষ্টা সাবেক ছাত্রনেতা আমান উল্লাহ আমান বলেন, এ পর্যায়ে তাদের পেছানোর কোনো উপায় নেই।


‘এ সরকারের অধীনে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে আমরা যাবো না এটা আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। এবং যুগপৎভাবে সেভাবেই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে এবং সেভাবেই কর্মসূচি চলছে,’ বলেন আমান। তিনি বলছেন নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিএনপির অবস্থান স্পষ্ট এবং আন্দোলনের মাধ্যমেই লক্ষ্য পূরণ করতে চায় বিএনপি।
‘আমাদের বক্তব্য কিন্তু স্পষ্ট, পরিষ্কার। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে যে এই সরকারের অধীনে আমরা কোনো নির্বাচনে যাবো না। এবং অতীতের মতো সেই ধরনের কোনো নির্বাচন এই সরকারকে জনগণ করতেও দেবে না।’ এ জন্য যে ধরনের কর্মসূচি প্রয়োজন ঠিক সে ধরনের কর্মসূচি ভবিষ্যতে ‘জনগণকে সাথে’ নিয়ে দেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন আমান। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলছেন এবার সরকারের বিরুদ্ধে ‘গণ-আন্দোলন’ সৃষ্টি হবে বলে তারা আত্মবিশ্বাসী। তবে সেটি সহজ হবে না বলে মনে করছেন মাহমুদ। ‘একটু কঠিন হবে কেননা এত নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা আমরা কখনোই দেখি নাই, এখন যা দেখছি। আমরা যা বলছি আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি, শান্তিপূর্ণভাবে চলার চেষ্টা করছি।’ পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক না কেন, আন্দোলনে সফলতার আশার করছেন মাহমুদ।
অন্য দিকে বিএনপির আন্দোলনকে খুব একটা ‘হুমকি’ হিসেবে দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ মনে করছে, বিএনপি যে দাবি করছে সেই ‘সক্ষমতা’ তাদের নেই। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো: মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, আন্দোলন করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব হবে না। বর্তমান বিএনপিকে একটি ‘জনবিচ্ছিন্ন’ দল হিসেবেও অভিহিত করেন তিনি। অতীতের উদাহরণ টেনে মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, আওয়ামী লীগ এরশাদ এবং খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে।


‘আমরা খালেদা জিয়ার একদলীয় নির্বাচনের বিরুদ্ধে ৪৫ দিনের মাথায় তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছি আন্দোলন করে। এ নজিরতো আছে। এমনকি ২০০৬ সালে বেগম জিয়াতো ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য নানা কৌশল করেছিল। সেখানেও কিন্তু আমরা আন্দোলন করে ক্ষমতাচ্যুত করেছি।’ হানিফ দাবি করেন আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার সক্ষমতা আওয়ামী লীগের থাকলেও বিএনপির সেই সক্ষমতা নেই। যদিও আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে বিএনপির আন্দোলনকে হুমকি হিসেবে স্বীকার করছে না তবে তারা রাজপথ দখলে রাখার ঘোষণা দিয়ে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে।
হানিফ বলেন, ‘ভবিষ্যতে যাতে বিএনপি এ ধরনের কর্মকাণ্ড না করতে পারে, বিশেষ করে আন্দোলনের নাম করে যাতে জনগণের সম্পত্তি বিনষ্ট করা বা দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে না পারে, সেই কারণেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।’ রাজনীতির মাঠে বিএনপির ও আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি অবস্থান এবং বিপরীতমুখী বক্তব্য বিবৃতিকে স্বাভাবিক রাজনীতি হিসেবেই দেখেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন বিএনপির বর্তমান আন্দোলন কর্মসূচি দিয়ে যেমন ‘গণ-অভ্যুত্থান’ সম্ভব নয় তেমনি দলটি যে একেবারেই জনবিচ্ছিন্ন সেটিও ঠিক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোর জন্য আওয়ামী লীগ যেভাবে মাঠে নেমেছে তাতে এটা মনে হয় যে বিএনপির জনসম্পৃক্ততা ধীরে ধীরে বাড়ছে
‘বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে লম্বা সময় চুপচাপ থেকে সংগঠন গুছিয়ে এখন জনসম্পৃক্ততার দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে একটা ইতিবাচক দিক। যে রাজনীতিটাকে তারা সুসংহত করছে,’ বলেন অধ্যাপক চক্রবর্তী। কিন্তু দশ দফা দাবি আদায়ে বিএনপির চলমান কর্মসূচি দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ‘গণ অভ্যুত্থান’ সৃষ্টি করা কতটা সম্ভব হবে সেটি নিয়ে সন্দেহ আছে চক্রবর্তীর।


তিনি মনে করেন, এ কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে বাধ্য করা খুব কঠিন। ‘প্রথমত এই সরকার একটা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলছে। দ্বিতীয়ত সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক কাঠামোটা নেই। আর তৃতীয়ত হলো, বিএনপি যে পর্যায়ে মুভমেন্ট করছে এ রকম মুভমেন্ট দিয়ে সরকার পতন ঘটানো কিংবা ওই ধরনের দাবি আদায় করা কঠিন।’
নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি হিসেবে গোবিন্দ চক্রবর্তী বলছেন, দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে জনসম্পৃক্ততার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিএনিপকে এমন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে যেখানে জনসম্পৃক্ততা বেশি। ‘কিন্তু আমার মনে হয় জনগণের একটা বড় অংশ কিন্তু এই ধারাবাহিকতাকে এবং সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার পক্ষেও কথা বলছে,’ বলেন অধ্যাপক চক্রবর্তী। ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণ-আন্দোলন হয়েছিল, যে জেরে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল জেনারেল এরশাদকে। সে আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সবগুলো রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল। ১৯৯৬ সালেও বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবিতে গণ-আন্দোলন হয়েছে যার নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটাতে আরেকটি গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করতে চাইছে বিএনপি।
কিন্তু বর্তমানে বিএনপি যেসব কর্মসূচি দিয়ে ‘যুগপৎ আন্দোলন’ করছে সেটি দাবি পূরণে কতটা কাজে দেবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে অনেকের।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগও আন্দোলন মোকাবেলায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে। একটি ‘গণ-অভ্যুত্থান’ সৃষ্টির মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি বিএনপি এখনো দিতে পারেনি বলেই মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী।


‘খালি মিছিল আর সভা সমাবেশ করে সরকারকে তাদের দাবির মুখে নত করতে পারবে না। তাদের আন্দোলনকে জোরদার করতে হবে। এবং বিএনপির এ কথাটা মনে রাখতে হবে যে বিএনপি একাই কিন্তু এই আন্দোলনটা চালিয়ে যেতে হবে। আপনার সমমনা দলদের কাছ থেকে খুব একটা আশা করা, যে ছোট ছোট দলগুলো সেটা হবে না।’ আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই যেহেতু রাজপথে আছে বিএনপি সেই দিক থেকে ২০২৩ সাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে একটা গুরুত্বপূর্ণ বছর।
দিলারা চৌধুরী মনে করেন, পরপর দু’টি জাতীয় নির্বাচন বিতর্কিত হওয়ার কারণে বিএনপির দাবির প্রতি সমর্থন আছে বাংলাদেশের অনেক মানুষের।
তিনি মনে করেন, সরকারের অনুমতি নিয়ে রাস্তায় মিছিল সমাবেশ করলে আন্দোলন সফল হবে না। ‘সরকারের অনুমতি নিয়ে একটা মিছিল করলে আর দশটা সভা করলে সরকার একটুও বিচলিত হবে না বলে আমি মনে করি।’
নির্বাচনকে সামনে রেখে দশ দফা দাবি আদায়ে চারটি জোটকে নিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিএনপি। নির্বাচনের আগে ঘেরাও, রোডমার্চ এবং লাগাতার কর্মসূচি পালনের ইঙ্গিত রয়েছে দলটির নীতিনির্ধারকদের কথায়।
গত বছর সবশেষ দশটি বিভাগীয় গণসমাবেশ কর্মসূচিতেও বিএনপি নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করেছিল কিন্তু ১০ ডিসেম্বরের পর সেই আন্দোলনে খানিকটা ভাটা পড়েছে বলেও অনেকে মনে করেন। কিন্তু এই পরিস্থিতি পরিবর্তন হবে নির্বাচনের আগে এমনটাই মনে করছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ। তার ভাষায়, ‘এ ধরনের একটি আন্দোলন টানতে গেলে এটা নদীর জোয়ার ভাটার মতো। জোয়ার আসে আবার নেমে যায়। কিন্তু এই জোয়ার আসা নামার পরেই একটা সাইক্লোন হয়। সেইটা একদিন ঘটবে এখানে।’

 


আরো সংবাদ



premium cement
জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজে অভিযানের প্রস্তুতি, দুই দস্যু আটক ভাঙ্গায় গৃহবধূর ৩ মেয়েসন্তান প্রসব, সাহায্যের আবেদন ব্যারিস্টার কাজলের মুক্তির দাবিতে বার কাউন্সিলের সামনে আইনজীবী সমাবেশ টাঙ্গাইলে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ, ২ জনের যাবজ্জীবন কেনিয়ায় বাস দুর্ঘটনায় ১১ শিক্ষার্থী নিহত খুলনার ইঁদুর মারার বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে বউ-শাশুড়ির মৃত্যু কুবিতে‘বেআইনিভাবে' ডিন নিয়োগের প্রতিবাদে সিন্ডিকেট সদস্যের পদত্যাগ জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে সরকার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে না : মির্জা ফখরুল গাজায় ত্রাণ প্রবেশে ইসরাইলের নিষেধাজ্ঞা যুদ্ধাপরাধের শামিল : জাতিসঙ্ঘ সঙ্গীতশিল্পী খালিদকে বাবা-মায়ের পাশে গোপালগঞ্জে দাফন রাণীনগরে টমটম গাড়ির ধাক্কায় নিহত ১

সকল