১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

জনশক্তি ব্যুরোতে সক্রিয় জালিয়াত চক্র

ফ্রি স্টাইলে চলছে অনিয়ম
-


জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর কর্মকর্তাদের সিল-স্বাক্ষর জাল করে বিদেশগামী কর্মীদের বহির্গমন ছাড়পত্র গ্রহণে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এভাবে অনিয়ম করে বহির্গমন ছাড়পত্র গ্রহণের কারণে দুবাইসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমানো শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই এখনো নানা সমস্যার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
সর্বশেষ গত বুধবার দু’টি এজেন্সির নামে সৌদি আরবগামী ১২০ জন কর্মীর স্মার্টকার্ড নেয়ার ক্ষেত্রে জাল-জালিয়াতির ঘটনাটি প্রথমে কর্মকর্তাদের নজরে আসে। এরপরই পুরো বিএমইটি জুড়ে হুলস্থূল শুরু হয়। কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে যায় সব কার্যক্রম। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ওই দিন কঠোর অবস্থান নিলেও পরে আর কেউ কোনো কথা বলছেন না।
অভিযোগ রয়েছে, এমন ঘটনা একদিন, দু’দিন নয় প্রায় ঘটলেও রহস্যজনক কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জড়িত এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে নীরব ভূমিকা পালন করছেন। এই সুযোগে দিন দিন আরো বেপোরোয়া হয়ে উঠছে ভিসা প্রসেসিংয়ের নামে গড়ে ওঠা অনিয়ম আর দুষ্টচক্র।
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক নাম না প্রকাশের শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, গত বুধবার সন্ধ্যার আগে দেখলাম হঠাৎ বিএমইটির কর্মকর্তারা তাদের সিকিউরিটি গার্ডদের দিয়ে এজেন্সির প্রতিনিধিদের বের করে দিচ্ছেন। এ নিয়ে এজেন্সির প্রতিনিধিদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কী হয়েছে, কোন ফাইলে সমস্যা, এ নিয়ে তাদের নিজেদের মধ্যেই গুঞ্জন শুরু হয়। ঘণ্টাখানেক পর অবশ্য পরিস্থিতি শান্ত হয়।


খোঁজ নিয়ে ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরবগামী ১২০ জন কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্র এবং স্মার্টকার্ড নিতে দু’টি রিক্রুটিং এজেন্সির নামে ভিসা প্রসেসিংকারী একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে (রিক্রুটিং এজেন্সি) বহির্গমন সেকশনে ফাইল দেয়া হয়। ওই ফাইলটি সই হয়ে নিয়ম অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সহকারী পরিচালক, উপপরিচালক, পরিচালক (বহির্গমন) হয়ে এডিজি পর্যন্ত চলে যায়। পরে ফাইল আবার একই প্রক্রিয়ায় ডাউন হয়। এ সময় কিছু কর্মকর্তা ফাইলটি দেখে সন্দেহ পোষণ করেন। এই ফাইলে তার স্বাক্ষর এলো কিভাবে? এরপরই বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। দু’টি প্রতিষ্ঠানের নামে ১২০ জন কর্মীর স্মার্টকার্ড বের হওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে কিছুটা সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এরপরই তারা জাল জালিয়াতির ঘটনাটির রহস্য উদঘাটনে সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দেন কিছুক্ষণের জন্য। ডেকে নেয়া হয় অভিযোগের তীর একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিককে। এরই ধারাবাহিকতায় বিএমইটির অভ্যন্তরে থাকা রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকদের প্রতিনিধিদের বের করে দেয়া হয়। পরে শোনা যায়, অনিয়মের সাথে জড়িত ওই এজেন্সির সার্ভার লক করে দেয়া হবে। কিন্তু বিষয়টি আর বেশি দূর এগোয়নি। এর পেছনে কী রহস্য রয়েছে তা উদঘাটনে ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন সাধারণ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা। কারণ ভিসা প্রসেসিংয়ের নামে গড়ে ওঠা দুষ্ট চক্রের কারণে বৈধভাবে ভিসা প্রসেসিংয়ের সাথে সম্পৃক্ত এজেন্সি মালিকরা কর্মকর্তাদের কাছে প্রতিনিয়ত হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হন। আটকে যায় তাদের ওই দিনের প্রসেসিং ব্যবসাও। এতে বিদেশগামীদের যাত্রা বিলম্ব হয় বলে তারা অভিযোগ করেন। দু’টি এজেন্সির নামে জমা দেয়া সন্দেহজনক ওই রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকের সাথে গত বৃহস্পতিবার রাতে নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে ‘প’ অদ্যাক্ষরের ওই রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক একটি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের নামে বিএমইটিতে সৌদি আরবের ভিসা প্রসেসিং করার জন্য কোনো ফাইল বা স্মার্টকার্ড নেয়া হয়নি। এসব মিথ্যা অপপ্রচার। যারা এসব বলছে মূলত তারাই তাকে ফাঁসাতে নানাভাবে চেষ্টা করছে। এর আগে তারাই দুবাইয়ে লোক পাঠানোর নামে বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে জালিয়াতি করেছে বলে দাবি করেন তিনি।


গতকাল জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) অতিরিক্ত মহাপরিচালক আনোয়ার পাশার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ দিকে জনশক্তি ব্যুরোর বহির্গমন শাখায় ফাইল আটকিয়ে রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক ও প্রতিনিধিদের হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে এজেন্সি মালিকদের পক্ষ থেকে। যথাসময়ে ফাইল সই না হওয়ার কারণে তাদের অনেক বিদেশগামী যাত্রীর যাত্রা আটকে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাতে এ প্রসঙ্গে একজন ভিসা প্রসেসিংকারী একজন ব্যবসায়ী বলেন, বিএমইটিতে শুধু বহির্গমন শাখায় ফাইল আটকে থাকে তা কিন্তু নয়, বিএমইটির অন্যান্য সেকশনেও রয়েছে সমস্যা। এসব মন্ত্রণালয়ের দেখা দরকার বলে তিনি দাবি করেন।
তবে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক (বহির্গমন) অবশ্য বলছেন ভিন্ন কথা। গত সপ্তাহে তিনি তার দফতরে নয়া দিগন্তের এ প্রতিবেদককে ফাইল আটকে থাকা প্রসঙ্গে বলেন, এই যে দেখছেন আমার রুমে ফাইলের স্তূপ। এর আগে কিন্তু অনেক ফাইল আমি সই করে ছেড়ে দিয়েছি। যেগুলোতে সমস্যা মনে করছি সেগুলোর জন্য যাত্রীদের ডেকে সাক্ষাৎ নিচ্ছি। যাচাই-বাছাই করে তারপর স্বাক্ষর করছি। এতে একটু সময় লাগছে। এর আগে জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরোর ক্লিন ইমেজের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া উপপরিচালক সাজ্জাদ হোসেন তার দফতরে এই প্রতিবেদককে বলেন, বিএমইটিতে আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত (কমপক্ষে ৫০০ ফাইল) যে সার্ভিস দিচ্ছি সেটা বাংলাদেশের কোনো দফতরই নয়, পৃথিবীর কোনো দেশে আছে কিনা তা নিয়ে আমার জানতে মন চায়। আমার মনে হয়, নাই। তিনি বলেন, আমরা অফিস সময়ের পর চেষ্টা করি কর্মীদের প্রতিটা ফাইল দেখে দ্রুত ছেড়ে দিতে। কারণ আমার স্বাক্ষরের পরই ওই কর্মীর বিদেশ যাওয়াটা ৯৫ শতাংশ নিশ্চিত হয়। তিনি মালয়েশিয়ামী ১৭৪৪ জন কর্মীর বহির্গমন ছাড়পত্রের একটি পরিসংখ্যান দেখিয়ে বলেন, মালয়েশিয়ার বহির্গমনের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় ফাইল। আজ সব কর্মীর বহির্গমনের ফাইলে স্বাক্ষর করলাম। এই কর্মীর প্রতিটি মায়েরাই তার সন্তানের আজ স্মার্টকার্ড হচ্ছে কিনা তার জন্য অপেক্ষায় আছেন। যখন শুনবেন স্মার্ট হয়ে গেছে তখন তারা মন থেকে দোয়া করবেন। আমরা মানবিক বিষয়টিকে গুরুত্ব দেই। অন্তত ওই ১৭৪৪ জন কর্মীর মায়েরা তো আজ দোয়া করবেন। এটাই তো বড় পাওনা। তাই সময় বেশি লাগলেও দিন শেষে শান্তি মনে বাসায় ফিরতে পারি। তবে মনটা খারাপ লাগে তখনই, যখন দেখি বিএমইটি নিয়ে কিছু মিডিয়াতে শুধু নেগেটিভ সংবাদ ছাপা হয়। আমরা কি ভালো কাজ করি না?

 


আরো সংবাদ



premium cement