২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঝুঁকি বাড়ছে ব্যাংকিং খাতে

৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১৯ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা
-

অনিয়মতান্ত্রিক ঋণ ও যথাসময়ে তা পরিশোধ না করায় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে খেলাপি হয়ে যাওয়া ৮৮ ভাগ অর্থই কুঋণে পরিণত হয়েছে, যা আদায় অযোগ্য ঋণ হিসেবে ধরা হয়। এ কুঋণ বেড়ে যাওয়ায় একদিকে ব্যাংকিং খাতের আয়ের বড় একটি অংশ আয়খাতে নেয়া যাচ্ছে না, অর্থাৎ অর্জিত সুদ স্থগিত করে রাখা হচ্ছে। অপরদিকে, যে আয় হচ্ছে তা দিয়ে ঋণ ঝুঁকি কমাতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো।

এতে ব্যাংকিং খাতে সামগ্রিকভাবে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত সেপ্টেম্বর শেষে শুধু ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ১৯ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। এর প্রভাবে ব্যাংক খাতে সার্বিকভাবে প্রভিশন ঘাটতি ১৩ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, সামগ্রিক প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর আয় কমে যাচ্ছে। সাধারণ গ্রাহকদের কাক্সিক্ষত হারে লভ্যাংশ দিতে পারছে না। আর প্রতিযোগিতামূলক মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সক্ষমতা অর্জনের জন্য ব্যাসেল-৩ আদর্শ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হয়। এতে সামগ্রিক ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে পুরো ব্যাংকিং খাতে।

প্রভিশন হলো ব্যাংকের একটি অন্যতম সূচক এবং আধুনিক হিসাববিজ্ঞানের একটি কার্যক্রম যেখানে লাভের কিছু অংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসাবে রাখা হয়। ঋণ-বিনিয়োগ প্রদানের ফলে যে অংশটুকু অনাদায়ী হয়ে যায় এবং আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা নিশ্চিত হওয়া যায় না, ফলে সম্ভাব্য ক্ষতির সৃষ্টি হয়। সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবেলায় খেলাপি ঋণের মান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় যে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করে তা নির্ধারিত সময় শেষে সুদে-আসলে ফেরত দিতে হয়। ব্যাংক আমানত নিয়ে বেশি সুদে ঋণ দিয়ে থাকে। ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে সুদে-আসলে আদায় করার পর তা আমানতকারীদের মুনাফাসহ ফেরত দেয়া হয়। ঋণ ও আমানতের সুদ হারের পার্থক্যই হলো মুনাফা। কোনো কারণে গ্রাহক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা কমে যায়। আর এ সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের আয় থেকে একটি অংশ জমা রাখতে হয়, যা ব্যাংকিং ভাষায় প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি বলা হয়।

সাধারণত খেলাপি ঋণ ভেদে ২০ শতাংশ থেকে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। উচ্চ মানের খেলাপি ঋণ বা কুঋণ হলে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। সন্দেহজনক বা মধ্য মানের খেলাপি হলে ৫০ শতাংশ এবং নি¤œ মানের খেলাপি হলে ২০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আবার নিয়মিত ঋণের বিপরীতেও প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের নিয়মিত ঋণের বিপরীতে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে এসএমই ঋণের বিপরীতে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ এবং ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ সংরক্ষণ করতে হয়। যার ফলে ব্যাংক সব ধরনের ঝুঁকিমুক্ত থাকে।

কোনো দেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিদেশী ব্যবসায়ীরা সাধারণত ব্যাংকের মূলধনের ভিত্তি ও খেলাপি ঋণ পর্যবেক্ষণ করে। শ্রেণিকৃত ঋণের সঙ্গে প্রভিশন ঘাটতির বিষয়টি সম্পর্কযুক্ত। যখন কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি থাকে তখন সেই ব্যাংক কোনো নতুন শাখা খুলতে পারে না; ক্যামেল রেটিং খারাপ হয়; ব্যাংকের তহবিল ব্যয় (কস্ট অব ফান্ড) বেড়ে যায়; পুঁজিবাজারে ব্যাংকের শেয়ারমূল্য কমে যায়; বৈদেশিক বাণিজ্য করার জন্য শাখা খোলার অনুমোদন পায় না; ব্যাংকের রিটেন আর্নিং ও শেয়ার প্রতি আয় কমে যায় এবং মূলধন ঘাটতিতে টান পড়ে। আর মূলধন ঘাটতিতে টান পড়লে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী ওই ব্যাংক বছর শেষে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। প্রভিশন ঘাটতি সমন্বয় করতে না পারলে বছর শেষে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি দেখা দেবে, সেই সাথে কমে যাবে ব্যাংকের মুনাফা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে রেকর্ড ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৮৮ শতাংশের বেশি কুঋণ বা মন্দ ঋণ। এ মন্দ ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোর সুদ আয় স্থগিত রাখা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪৭ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ সঙ্কটের কারণে অনেক ব্যাংকই প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে ৮টি ব্যাংক। এর মধ্যে চারটি সরকারি ও ৪টি বেসরকারি খাতের বাণিজ্যিক ব্যাংক রয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী, বেসিক, জনতা, রূপালী, বেসরকারি বাংলাদেশ কমার্স, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ১১ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে বেসিক ব্যাংকের। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। এর পরেই রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক, যার প্রভিশন ঘাটতি ৩ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে রূপালী ব্যাংক লিমিটেড। ৩ হাজার ১৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকটি। চতুর্থ অবস্থানে থাকা জনতা ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৫৯৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।

আর বেসরকারি খাতের চারটি ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৮ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৭ হাজার ৪৭৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৪৪ কোটি ৬৮ লাখ, মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৪৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৮৮ হাজার ৬৮৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা। কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়েছে ৭৫ হাজার ১৫৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি ১৩ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা জানিযেছেন, প্রভিশন ঘাটতির কারণে শুধু যে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকই বিপদে আছে তা নয়, আমানতকারীরা ও শেয়ারমালিকরাও বিপদে পড়ে। প্রভিশন সংরক্ষণ করার কারণে ব্যাংকের আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অলস অর্থ হিসেবে পড়ে থাকে প্রভিশন রিজার্ভ হিসেবে, যা ব্যাংক ভোগ বা খরচ করতে পারে না, লভ্যাংশ হিসাবে বিতরণ করতে পারে না, নিতে পারে না রিটেন আর্নিং হিসাবে মূলধন খাতে বা বিতরণ করতে পারে না ঋণ হিসাবে। সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো ব্যাংককে টানা দুই বছর প্রভিশন ঘাটতি থাকলে তার বড় অঙ্কের জরিমানাসহ লাইসেন্স বাতিলের কথা বলা হয়েছে।

অপর দিকে প্রতিযোগিতামূলক মুক্তবাজার অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল সক্ষমতা অর্জনের জন্য ব্যাসেল-৩ আদর্শ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হয়। এতে সামগ্রিক ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে পুরো ব্যাংকিং খাতে। এ ঝুঁকি কমাতে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়ার বিকল্প নেই বলে ব্যাংকাররা মনে করেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল