২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মৌজাভিত্তিক নয়, বাজারদরে জমি কেনাবেচায় কমিটি

-

জমি কেনাবেচায় মৌজাদর পদ্ধতি আর থাকছে না। সামনে জমি কেনাবেচা হবে বাজারদর অনুযায়ী। বাজারমূল্যে জমি কেনাবেচাবিষয়ক একটি কার্যকর নতুন পদ্ধতি বের করতে সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহকে ইতোমধ্যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত গঠিত একটি কমিটিকে আগামী ১ ডিসেম্বরের মধ্যে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনাসংবলিত একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, সরকার জমির নিবন্ধন ফি থেকে বছরে সাত থেকে আট হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পায়।

গত ৭ নভেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে এ বিষয়ক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির ২৬তম সভা গত ২৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় জমি কেনাবেচায় মৌজাদর পদ্ধতি আর থাকবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। এর বদলে যে দামে জমি কেনাবেচা হয়, সে দামেই হবে জমির নিবন্ধন বা দলিল।’
জমি রেজিস্ট্রেশনে স্বচ্ছতা আনা এবং বাজারদরে জমির নিবন্ধন বা দলিলব্যবস্থা চালু করতে একটি কমিটি করেছে সরকার। সাত সদস্যের এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিবকে (কেন্দ্রীয় ব্যাংক)।

কমিটির অপর পাঁচ সদস্য হলেন ভূমি মন্ত্রণালয়, সংসদ বিষয়ক বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং নিবন্ধন অধিদফতরের একজন করে প্রতিনিধি। কমিটিতে সদস্যসচিবের দায়িত্ব পালন করবেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব (কেন্দ্রীয় ব্যাংক)। ওই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে গত ৬ নভেম্বর বাজারদরেই জমির দলিলব্যবস্থা বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আরেকটি সভা হয়। সোমবারের বৈঠকটি ওই সিদ্ধান্তের আলোকেই এবং এতে কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটিতে সদস্য হিসেবে কাদের নাম রাখা হবে তা চূড়ান্ত করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠাতে এনবিআর চেয়ারম্যান, ভূমি সচিব, আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সচিব, বিএফআইইউ’র প্রধান কর্মকর্তা, নিবন্ধন অধিদফতরের মহাপরিদর্শক, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যুগ্ম সচিব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিনিয়র সহকারী সচিবকে অনুরোধ করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে বলা আরো হয়, নিবন্ধন অধিদফতর কমিটিকে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করবে এবং বিএফআইইউ কমিটিকে সার্বিক সহায়তা প্রদান করবে। সরকারি কর্মকর্তাদের যুক্তি হলো- উচ্চমূল্যের জমি অনেক কম মূল্য দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করায় বিপুল পরিমাণ বৈধ অর্থ অবৈধ হয়ে যায়। পরে ওই অবৈধ অর্থই বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তারা বলছেন, জমি নিবন্ধন বাজারভিত্তিক হলে বিদেশে অর্থ পাচার কমবে। তারা বলছেন, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা কঠিন। কিন্তু অর্থ পাচার রোধ করা অনেক সহজ। এতে মানিলন্ডারিংও কমে যাবে। লেনদেন বাজারভিত্তিক হলেই এ সমস্যার সমাধান হবে।

মৌজাদর হচ্ছে কোনো মৌজায় জমির সর্বনিম্ন দর। সারা দেশে ২০১৬ সালে সর্বশেষ মৌজাদর নির্ধারণ করা হয়। এখনো সেই দরে নিবন্ধন চলছে। মৌজাদর সবচেয়ে কম নির্ধারণ করা আছে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়। গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি, মতিঝিল, পল্টন, মহাখালীর মতো অনেকে এলাকায় যে মৌজাদর নির্ধারণ করা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে জমি কেনাবেচা হয়ে থাকে এর চেয়ে ১০০ থেকে ২০০ গুণ বেশি দরে। এটা যেমন বাস্তবতা, আবার ঢাকার বাইরে মৌজাদরের সাথে জমির প্রকৃত দরের খুব বেশি পার্থক্য নেই। ন্যূনতম মৌজাদর নির্ধারণ করা হলে জমির সাধারণ ক্রেতারা সমস্যায় পড়বেন। বেশি দামে জমির মৌজাদর নির্ধারণ করা হলে তারা হয়তো জমির নিবন্ধনের ফি দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে পারেন।

জমি কেনাবেচায় নতুন মৌজাদর কার্যকর হলে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। তবে এটা অনুমান করা যায়, মৌজাদর বাজারভিত্তিক হলে জমির দাম বেড়ে যাবে। বাংলাদেশে জমির নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) ফি অনেক বেশি। এর সাথে বাজারদরে মৌজাদর নির্ধারণ করা হলে জমির দাম আরো বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে জমির নিবন্ধন ফি ১০ শতাংশের উপরে। অন্যান্য দেশে জমির নিবন্ধন ফি ২ থেকে ৩ শতাংশ। মৌজাদরে কেনাবেচা চালু হলে জাতীয়ভাবে জমির নিবন্ধন ফি কমিয়ে আনতে হবে। তা না হলে জমির বেচাকেনা কমে যাবে। এমন হলে সরকারের রাজস্বও কমে যাবে। এতে ‘সরকার খুব বেশি লাভবান হবে না’ বলে মনে করি।

জমি কেনাবেচায় বাজারদরে মৌজাদর নির্ধারণে ঢাকার জমির ক্রেতা মো: আসাদুল ইসলাম বলছেন, রাজধানী ঢাকার পাশে সামান্য কিছু জমি কিনে একটি বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলাম। একটি জমি পছন্দও হয়েছে। জমি মালিকের সাথে দরকষাকষি চলছে; কিন্তু ডিসেম্বরে জমির নতুন মৌজাদর নির্ধারণ করা হলে আমি আর হয়তো জমি কিরতে পারব না। আমাকে তখন নতুন করে বেশি ফি দিতে হবে আবার জমি কেনাবেচায় দলিল করতে যে ঘুষ দিতে হয় তখন হয়তো তাও বেড়ে যাবে। আমার নিজস্ব বাড়ি করার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে, কখনো বাস্তবায়ন হবে বলে আর মনে হয় না।


আরো সংবাদ



premium cement