১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমি বিদায় নেয়ার জন্য প্রস্তুত

সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী
-

রাজনীতি থেকে বিদায় নেয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরে দলের কাউন্সিলে একজন কাউন্সিলরও যদি তাকে না চান তাহলে তিনি কোনোদিনও পদে থাকবেন না। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর নিয়ে জানাতে প্রধানমন্ত্রী এই সংবাদ সম্মেলনে আসেন।
আওয়ামী লীগের সম্মেলনে এবার কোনো চমক থাকবে কি না, কোনো নতুন নেতৃত্ব সামনে নিয়ে আসবেন কি না- এমন এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের একটি কাউন্সিলরও যদি বলেন, আমাকে চায় না, আমি থাকব না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কে থাকবে তা পুরোপুরি কাউন্সিলরদের সিদ্ধান্ত। আমার তো সময় হয়ে গেছে। বিদায় নেয়ার জন্য আমি প্রস্তুত।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ, স্যাংশন-পাল্টা স্যাংশনের মধ্যেও আমাদের অর্থনীতি যথেষ্ট সচল রাখতে পেরেছি। এটা শুধু আমাদের কথা নয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও তাই বলছে। তিনি বলেন, আমরা সরকারে আসার পর থেকেই একটার পর একটা সঙ্কট তৈরির চেষ্টা হয়েছে। জনগণের সমর্থন থাকায় এসব সঙ্কট মোকাবেলা করতে পেরেছি। শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের বিষয়ে লিখিত বক্তব্য দেন। পরে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন তিনি। বাসস, বাংলা ট্রিবিউন, জাগো নিউজ, বাংলানিউজ।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি বলে জানান। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে মিয়ানমার থেকে জোর করে বাস্তুচ্যুত ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়ে আসছে। মানবিক কারণে নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ সাময়িক আশ্রয় দিয়েছি।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে সম্মানের সাথে ও নিরাপদে তাদের নিজ দেশে ফিরতে পারে সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছার অভাবে নিরাপদ প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। এবার জাতিসঙ্ঘে দেয়া ভাষণে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানোর কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ তৈরিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করার জন্য জাতিসঙ্ঘকে কার্যকর ও জোরালো ভূমিকা রাখার জন্য আহ্বান জানিয়েছি।


জাতিসঙ্ঘে দেয়া ভাষণে রাশিয়া-ইউক্রেন বিরোধ নিরসনের আহ্বান জানানোর কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, করোনা মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্ঘাতের ফলে সৃষ্ট খাদ্য ও জ্বালানি সঙ্কট এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির জন্য অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক পারস্পরিক সংহতি প্রদর্শন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করি। এসব সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা-নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সঙ্কট ও বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই।
আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে এনেছেন উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে আমরা গণতন্ত্র উদ্ধার করি। আমরা একটানা তিনবার ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় আছি, গণতান্ত্রিক ধারা বাংলাদেশে অব্যাহত আছে। এর বাইরে অনেক চড়াই-উতরাই, খুন-খারাবি, অগ্নিসংযোগ, অগ্নিসন্ত্রাস অনেক কিছু হয়েছে। এরপরও আমরা ক্ষমতায় ছিলাম বলে আজ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ও ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। এখন বিদায় নেয়ার জন্য আমি প্রস্তুত।
এক প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামী বছর বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করছেন সবাই। এ নিয়ে সবাই আতঙ্কিত ও শঙ্কিত। পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশবাসীকে নিজ নিজ জমিতে চাষাবাদ করার জন্য আবারো অনুরোধ জানান তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, যারা স্বাধীনতা বিরোধী, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে এ দেশের মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, গণহত্যা, লুটপাট করেছে পঁচাত্তরের পরে তারাই ক্ষমতায় এসেছে। তাদের সাথে যারা হাত মেলাতে পারে। আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে সেই দেশে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রাখা কত দুরূহ, কত কঠিন সেটা নিশ্চয় সবাই বুঝতে পারেন।
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে সরকার গঠন করার পরে দেশে নানা ধরনের সঙ্কট সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে বলে দাবি করেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, জনগণের সমর্থন ছিল বলেই প্রতিটি সঙ্কট মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি। যখন বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলছিল, বাংলাদেশে শুধু একটি ঘটনাই ঘটেছিল (হোলি আর্টিজান) তাও কিন্তু ১২ ঘণ্টার মধ্যে সমাধান করেছি। এরপর থেকে তেমন কোনো ঘটনা ঘটতে আমরা দেইনি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের রিজার্ভ যথেষ্ট। যদি কোনো সঙ্কট আসে. তাহলে পাঁচ মাসের খাদ্য কেনার মতো সক্ষমতা আছে কিনা সেটা দেখা হয়। আমাদের তা আছে। বাংলাদেশ কখনো ঋণখেলাপি ছিল না বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। সঙ্কট মোকাবেলায় জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের কিছু কিছু পত্রিকা সারাজীবনই বাংলাদেশের খারাপ কথাটা বলতে পারলেই স্বস্তি পায়। এটা আমি যুগ যুগ ধরে দেখছি। এ রকম এক ধরনের মানুষ থাকে। সবসময় নেতিবাচক চিন্তা অথবা পরশ্রীকাতরতায় ভোগে। মানুষ যতই ভালো করুক, তাদের চোখে ভালো হওয়া যাবে না। তবে সেটা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই, চিন্তাও করি না। সরকারপ্রধান বলেন, বিরোধী দলের আন্দোলন, সংগ্রামের হুমকি, অনেক কিছু পাওয়া যাচ্ছে। সেটা তো তাদের কাজ। করতেই হবে। না হলে, বিরোধী দল কী? বিরোধী দল যদি শক্তিশালী হতো, তাহলে অনেক কিছুই হতো।


আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দল অংশ নেবে না বলে আসছে- এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকার কী ভাবছে? এই প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ নেয়া যেকোনো রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। আমরা কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। তবে চাইব- সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক।’ আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অনেক হুমকি দিচ্ছে। এটাই তো তাদের কাজ। যত উন্নয়নই হোক, বিরোধিতা করাটাই তাদের কাজ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপির তো খুঁটির জোর নেই। যদি সেটি থাকতো তাহলে তো তারা বিদেশীদের দ্বারে দ্বারে যেত না, ধরনা দিয়ে বেড়াত না।’ তিনি বলেন, ‘জনগণ বিএনপিকে সবক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা কোন মুখ নিয়ে জনগণের কাছে ভোট চাইতে যাবে। আগুন দিয়ে মানুষ পোড়ানো, পেট্রলবোমা মারা, নাশকতা করে মানুষ খুন করেছে। এখন মানুষের কাছে ভোট চাইতে যাবে কোন মুখ নিয়ে। পারছে না বলেই বিদেশীদের পিছে পিছে ঘুরছে।’ র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে করা আরেক প্রশ্নের জবাবে সরকারপ্রধান বলেন, ‘র‌্যাবকে আমেরিকা যেমন ট্রেনিং দিয়েছে, তারা তো তেমনই কাজ করছে।’ বাংলাদেশে সন্ত্রাস না থাকায় আমেরিকা নাখোশ কি না, সেই প্রশ্নও তোলেন প্রধানমন্ত্রী।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয় সফরে ব্রিটেন যান প্রধানমন্ত্রী। সেখানে তিনি রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেন। এরপর নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডন ত্যাগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে শেখ হাসিনা গত ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে ভাষণ দেন। সোমবার দিবাগত রাত ১টায় দেশে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী।
সরকার সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যে বলেন, জনগণের যেকোনো ধরনের দুর্ভোগ কমাতে তারা বিষয়টিতে মনোযোগ দিয়েছেন। তাছাড়া আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়েও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তিনি বলেন, বিদেশের কাছে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা না দেয়ায় দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি সত্য, কিন্তু তা করলে আজকে কিছুটা লোডশেডিং দিয়েও বিদ্যুৎ সঞ্চালন যেভাবে অব্যাহত রয়েছে তা সম্ভব হাতো না, দেশ অন্ধকারেই নিমজ্জিত হতো।
সংবাদ সম্মেলনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম।
ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতে গুরুত্বারোপ : প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতের সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায় বের করতে এবং দেশের মানুষকে এ ব্যাপারে সতর্ক করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এই নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাবের ফলে বিশ্ব আরো জটিল হয়ে উঠছে। বিশ্ব আজ একটি কঠিন সময় পার করছে এবং বাংলাদেশও এর বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন হচ্ছে। তাই দেশকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং দেশের অগ্রগতি ও উন্নতি অব্যাহত রাখতে এ ব্যাপারে সুপরিকল্পিত মতামত জরুরি।’ প্রধানমন্ত্রী গতকাল সকালে গণভবনে ন্যাশনাল ডিজিটাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সভায় একথা বলেন।


আরো সংবাদ



premium cement