২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

রূপপুরের দায় রুবলে শোধের দাবি নাকচ!

অস্বাভাবিক হারে সুদ গুনতে হবে ঢাকাকে; তিন বিকল্প প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকের
নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র -

রাশিয়ান অর্থায়নে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ ও সুদ পরিশোধে জটিলতা দেখা দিয়েছে। রাশিয়া চায় তাদের অর্থায়নের সুদ ও আসল ডলারের পরিবর্তে তাদের নিজস্ব মুদ্রা রুবলে পরিশোধ করা হোক। কিন্তু রুবলে পরিশোধে বাংলাদেশকে তিনবার মুদ্রাবিনিময় করতে হবে। এতে বিপুল অঙ্কের বিনিময়জনিত লোকসান হবে। এ লোকসান কে বহন করবে, তা রাশিয়া থেকে বলা হয়নি। এমনি পরিস্থিতিতে রাশিয়ার প্রস্তাব নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করেছে অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এরই মধ্যে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ঋণের অর্থ পরিশোধের পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর পক্ষ থেকে রাশিয়ার প্রস্তাব নাকচ করে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব ইআরডিকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ বিকল্প প্রস্তাবের মধ্যে অন্যতম হলো, বাংলাদেশ স্থানীয় মুদ্রা টাকা দিয়ে ডলার কিনবে। আর ডলার দিয়ে চাই না মুদ্রা ইউয়ান কিনবে। রাশিয়াকে তাদের নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ান কিনে নিতে হবে। আর এ জন্য মুদ্রাবিনিময়জনিত যে ক্ষতি হবে, তা রাশিয়াকে বহন করতে হবে। তবে ইআরডি এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত পৌঁছাতে পারেনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

ইআরডির পর্যালোচনায় বলা হয়, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে ঋণ চুক্তি হয়েছে লন্ডন আন্তঃব্যাংকের সুদের হারের (লাইবর) সুদের হারের ওপর ভিত্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে পরিশোধ করা হবে অন্য পদ্ধতিতে। লাইবরের বদলে প্রযোজ্য হবে মার্কিন টেকনোলজি সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেটের (সোফর) হার। লাইবর ও সোফর এক নয়, এর আর্থিক লেনদেনের বড় একটি ফারাক রয়েছে। যুক্তরাজ্যের মধ্যে নামকরা যে ১৬টি ব্যাংক রয়েছে তাদের এক মাসের লেনদেনের ভিত্তিতে যে দর নির্ধারণ করে সেটিই লাইবর। গত মাসে এ লাইবরের হার ছিল ৩.১২ শতাংশ। বর্তমানে রাশিয়ার যে সুদ পরিশোধ করা হচ্ছে তা এই ৩.১২ শতাংশ হারে পরিশোধ করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এই লাইবর সুদের হার অনুযায়ী পরিশোধ করতে হবে। আগামী ১ জুলাই থেকে পরিশোধ করতে হবে সোফর অনুযায়ী। বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। তাদের মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সুদের হারও বাড়ানো হচ্ছে।

কিন্তু বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এ কারণে সোফর হার দুই থেকে আড়াই শতাংশের মধ্যে রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী সোফর হার অনুযায়ী ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করা হলে বাংলাদেশের সুদ পরিশোধ ব্যয় অনেক কমে যাবে। কিন্তু বর্তমানে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সিস্টেমই মানতে চাচ্ছে না। তারা লাইবর হার অনুযায়ীই বাংলাদেশকে সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হবে বলে জানিয়েছে। এতে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধ ব্যয় কয়েক হাজার কোটি টাকা বেড়ে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

জানা গেছে, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে। তখন থেকে রাশিয়ার মুদ্রার মান ধরে রাখতে রাশিয়ার সাথে লেনদেন করতে রাশিয়ান মুদ্রা রুবল ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয় সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে; অর্থাৎ রুবল ক্রয় করে রাশিয়ার সাথে লেনদেন করতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশে দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াটরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় এক লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার সমান। এ প্রকল্পে রাশিয়া রূপপুরে ঋণ দিচ্ছে এক হাজার ১৩৮ কোটি ডলার। এই ঋণের ৪৯৭ কোটি ডলার এরই মধ্যে ছাড় করা হয়েছে। বাকি রয়েছে ৬৪১ কোটি ডলার।

রাশিয়ার ঋণের শর্তানুযায়ী ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে শুধু ঋণের সুদ এবং এর পর থেকে সুদ ও আসল বছরে বছরে পরিশোধ করতে হবে। রাশিয়া এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে ১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে, তার পুরো সুদ এখনো আমাদের পরিশোধ করতে হচ্ছে না। কিন্তু এরই মধ্যে যে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড় করা হয়েছে, তার সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। যদিও রাশিয়ার পক্ষ থেকে ভারতের মধ্যে যে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৬ বিলিয়ন ডলার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে, সেই একই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আমাদের দিতে হচ্ছে ১২ বিলিয়ন ডলার।

জানা গেছে, গত ২০১৩ সালে যখন রাশিয়ার সাথে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি করা হয়েছিল, তাতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ ছিল, এই প্রকল্পের ঋণের সুদ-আসল রাশিয়াকে ডলারে পরিশোধ করা হবে। যেহেতু ডলারের মূল্য স্থিতিশীল তাই অন্য মুদ্রা দিয়ে এই বিশাল অঙ্কের ঋণ সুদ-আসলে পরিশোধ করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অন্য মুদ্রার মান পরিবর্তন হলে এই ঋণের সুদ-আসলে পরিশোধ করতে বড় অঙ্কের লোকসানের মুখে পড়বে বাংলাদেশ। আর এ কারণেই চুক্তির সময় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ রাশিয়ার এই প্রকল্পের ঋণের সুদ-আসল ডলারে পরিশোধ করবে।

রাশিয়া প্রস্তাব করেছে, প্রথমে ডলার দিয়ে চায়না মুদ্রা ইউয়ান কিনতে হবে। আর ওই ইউয়ান দিয়ে রাশিয়ান মুদ্রা রুবল কিনে তা পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে বিনিময়জনিত ব্যয় ও লোকসানের দায় কে নেবে, সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

রাশিয়ার প্রস্তাব হলো রুবলে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার ও রুবলের বিনিময় হার হবে রুশ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিনিময় হার অনুযায়ী। প্রকৃত পরিশোধের তারিখের ১০ দিন আগের দরটি বিনিময় হার হিসেবে ধরা হবে। আর চুক্তি অনুযায়ী কোনোভাবেই ঋণ পরিশোধের কিস্তি বা সুদের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হওয়া যাবে না; অন্যথায় প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ থেমে যাবে।
বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় তার কিন্তু সুদের হার নির্ধারণ করা থাকে। আর ৩০ থেকে ৪০ বছর মেয়াদি ঋণের সুদ চুক্তি অনুযায়ী একই থাকে। কিন্তু রাশিয়া থেকে যে ঋণ নেয়া হচ্ছে তার সুদ দুই ধাপে পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।

ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি বাবদ ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছিল রাশিয়া। এই ঋণ সুদ-আসলসহ আট কিস্তি পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। ঋণের ৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ বা ১০ কোটি ডলার এখনো বকেয়া। ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। এই জটিলতায় রাশিয়াকে ১০ কোটি ডলার ফেরত দিতে পারছে না বাংলাদেশ। সঙ্কট নিরসনে রাশিয়া তাদের নিজস্ব মুদ্রা রুবলে ঋণ পরিশোধের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশকে। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে জড়ানোর পর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা ও বৈশ্বিক লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে রুশ ব্যাংকগুলোকে বের করে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া এ প্রস্তাব দেয়। রাশিয়ার পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে এ-সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয় গত ২৩ জুন। এর পর গত ১০ আগস্ট আরেকটি চিঠি দেয় রাশিয়া। এতে মার্কিন ডলার ও ইউরোতে লেনদেন নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে রুবলে লেনদেনের প্রস্তাব দেয়া হয়।

এ বিষয়ে গত ৫ সেপ্টেম্বর ইআরডির পক্ষ থেকে এক চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এ বিষয়ে পরামর্শ চাওয়া হয়। গত মাসের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে তিনটি বিকল্প পরামর্শ দিয়ে ইআরডিকে জানিয়ে দেয়া হয়। তবে এ বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি যখন অনুমোদন দেয়া হয় তখন আইনকানুনের ওপর ভিত্তি করে কিছু চুক্তিও করা হয়। নতুন করে রুবল বা ইউয়ানে দিলে সেই চুক্তি আবার সংশোধন করতে হবে। রুবল বা ইউয়ানে পরিশোধ করতে হলে পার করতে হবে কয়েকটি ধাপ। এর মধ্যে অন্যতম রুবল বা ইউয়ানও ডলার বিক্রি করে কিনতে হবে। কারণ রুবল বা ইউয়ানের তেমন কোনো শক্ত সোর্স বাংলাদেশের নেই। এ ছাড়া সব সময় রেট ওঠানামা করে। সেই হিসেবে অনেকটাই স্থিতিশীল ইউএস ডলার। সুতরাং এতে ক্ষতির সম্মুখীন হবে বাংলাদেশ। এর চেয়ে ডলারে পরিশোধ করা বাংলাদেশের জন্য সুবিধা। কারণ প্রচুর রেমিট্যান্স ডলারে আসে দেশে। এ ছাড়া এক্সপোর্টও হয় ইউএস ডলারে। এর বাইরে কোনো কারেন্সি পরিশোধ করতে হলে ডলার বিক্রি করে কেনা লাগবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এ কারণে বিকল্প তিনটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রথমে বাংলাদেশ ডলার কিনে তা ইউয়ানে রূপান্ত করা হবে। রাশিয়া রুবল দিয়ে ইউয়ান কিনে নেবে। এতে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে তা রাশিয়াকে বহন করতে হবে। আর এ জন্য উভয় দেশের একাউন্ট থাকবে চীনের কোনো ব্যাংকে। দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো বাংলাদেশ ডলারের বিনিময়ে ইউয়ান কিনবে। এক্ষেত্রে রাশিয়ার পক্ষে চীনের কোনো ব্যাংকে একাউন্ট থাকবে, আর বাংলাদেশের পক্ষেও চীনের একটি ব্যাংকে একাউন্ট থাকবে। আর তৃতীয় প্রস্তাব হলো রাশিয়ার পক্ষ থেকে চীনের কোনো ব্যাংকে একাউন্ট থ্কাবে। আর ওই একাউন্টে বাংলাদেশ ডলারের বিপরীতে ইউয়ান কিনে লেনদেন করবে। তবে উভয়ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে বিনিময়জনিত লোকসান হবে তা রাশিয়াকে বহন করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত বদরের শিক্ষায় ন্যায়-ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে : সেলিম উদ্দিন ইসলামের বিজয়ই বদরের মূল চেতনা : ছাত্রশিবির পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭২ হাজার মানুষের মৃত্যু : বিশ্বব্যাংক নোয়াখালীতে ল’ইয়ার্স কাউন্সিলের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ল’ ইয়ার্স কাউন্সিল কাজ করে যাচ্ছে’ পুকুরে পাওয়া গেল ১০০ ইলিশ

সকল