২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পঞ্চগড়ে নৌকাডুবিতে মৃত্যু সংখ্যা বেড়ে ৪৩

দিনাজপুরে উদ্ধার ৮ জনের লাশ
পঞ্চগড়ের করতোয়া তীরে নিখোঁজ স্বজনদের দীর্ঘ প্রতীক্ষা : নয়া দিগন্ত -

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাটে নৌকাডুবির ঘটনায় গতকাল সোমবার আরো ১৮টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে নৌকাডুবিতে এ পর্যন্ত ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার করা হলো। এখনো নিখোঁজ রয়েছে অনেকে। নিখোঁজদের সন্ধানে তাদের স্বজনরা ভিড় করছেন নদীর তীরে। স্থানীয়দের নিয়ে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। নিখোঁজদের খোঁজে অনেকেই ভিড় করছেন মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য কেন্দ্রে। নতুন করে কোনো লাশ উদ্ধার হওয়ার সাথে সাথে তথ্যকেন্দ্রের বাইরে বোর্ডে ছবি লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। পরিচয় নিশ্চিতের পর সেখানে নাম ও ঠিকানা লেখা হচ্ছে।
গতকাল সোমবার বিকেল পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্যে যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে তারা হলো বোদা উপজেলার মাড়েয়া শালবাড়ী গ্রামের সুচিত্রা রানী (২২), আটোয়ারী উপজেলার ঝর্ণা পাল, শালডাঙ্গা মধ্য শিকারপুর গ্রামের দিপবাবু (২২), মাড়েয়া বটতলী গ্রামের জগদীশ (৩৫), মাড়েয়া আরাজী শিকারপুর গ্রামের কবিতা রানী (৩৩), মাড়েয়া গেদীপাড়া গ্রামের বেজ্য বালা (৫০), পাশের ঠাকুরগাঁও জেলার দেবীপুর মুজাবনী গ্রামের দীপশিখা রানী, মাড়েয়া শাশবাড়ী গ্রামের সুব্রত (২), বোদা কলেজপাড়ার যতি মিম্রয় রায় (১৫), বোদা উপজেলার পাঁচ পীর বংশীধর পূজারী গ্রামের দেন্দা রানী, একই উপজেলার মাড়েয়া কাউয়াখাল গ্রামের সুমিত্রা রানী, চন্দনবাড়ী শিকারপুর প্রধানপাড়া গ্রামের আদরী (৫০), দেবীগঞ্জের লক্ষ্মীরহাট কেকে বাড়ির পুস্পা রানী।


গত রোববার মহালয়া উপলক্ষে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নৌকায় করে বোদা উপজেলার বরদেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিলেন উৎসবে যোগ দিতে। দুপুরের দিকে মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় একটি নৌকা উল্টে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, নৌকাটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিল। কিছু মানুষ সাঁতরে নদীর তীরে ফিরতে পারলেও অনেকে নিখোঁজ থাকেন। নৌকাডুবির পরপরই স্থানীয়রা নৌকা নিয়ে উদ্ধারকাজ শুরু করেন। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা নামেন তল্লাশিতে।
পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক শেখ মাহবুব ইসলাম জানান, রোববার ২৫ জনের লাশ উদ্ধারের পর রাতে নদীতে তল্লাশি সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছিল। সোমবার ভোর সাড়ে ৫টায় নতুন করে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। রাজশাহী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম থেকে আসা ডুবুরি দলও এখন অভিযানে অংশ নেন।
এ দিকে গতকাল দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত ঘটনাস্থল, তথ্যকেন্দ্র ও নিহত ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়ে সমবেদনা জানিয়েছেন রেলপথ মন্ত্রী ও পঞ্চগড়-২ আসনের সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম সুজন। তার সাথে ছিলেন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান, দিনাজপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপাল, পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো: জহুরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম শফিকুল ইসলাম, বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সলেমান আলীসহ কর্মকর্তারা। বিকেলে তারা দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের ছত্র শিকারপুর হাতিডোবা গ্রামের বীরেন চন্দ্র রায়ের বাড়িতে যান। নৌকাডুবিতে বীরেন রায়ের দুই পুত্রবধূ ও দুই নাতি মারা গেছে। সেখানে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চারজনের জন্য এক লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করা হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ২৫ হাজার টাকার চেক প্রদান করা হচ্ছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতপ্রতি পরিবারের স্বজনদের হাতে লাশ সৎকারের জন্য ২০ হাজার টাকা এবং আহতদের চিকিৎসায় ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হচ্ছে।


গতকাল সকালে আউলিয়ার ঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিস এবং ডুবুরি দলের তিনটি ইউনিট উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে। তাদের সহযোগিতা করছেন স্থানীয়রা। সেখানে ভিড় করছে নিখোঁজদের স্বজনেরা। নাতির খোঁজে উপজেলার পাঁচপীর এলাকা থেকে এসেছেন বৃদ্ধ সুমল চন্দ্র। তিনি বলেন, নাতির লাশটা পেলে অন্তত নিজেরা সৎকারের কাজটা করতে পারতাম। মাড়েয়া বটতলি এলাকার ধীরেন বাবুর দুই প্রতিবেশীসহ সাতজন নিকটাত্মীয় এখনো নিখোঁজ। নৌকাডুবির পর থেকে তিনি নদীর পাড়ে অপেক্ষা করছেন। তিনি বলেন, বোদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজায় যোগ দিতে আমার ভাতিজা, ভাতিজার বউ, ভাতিজার শ্বশুর, শ্যালিকা এবং আমার ভাতিজি নৌকায় ওঠে দুর্ঘটনায় পড়েন। এখন পর্যন্ত কারো খোঁজ পাইনি। এখন তাদের লাশের অপেক্ষা করছি। আউলিয়ার ঘাট থেকে দিনাজপুরের খানসামা জিয়া সেতু পর্যন্ত করতোয়া নদীর ৩০ কিলোমিটার ভাটি অংশের তিনটি স্থানে ১২ সদস্যের ডুবুুরি দল উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ঢাকা সদর দফতরের পরিচালক অপারেশন লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান জানান, সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান চলবে। পানিতে ডুবে থাকা যেকোনো মানুষের লাশ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই ভেসে উঠবে। সেই মোতাবেক ২৭ নভেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত অভিযান চালু রাখবেন বলে তিনি জানান।


৮ জনের লাশ দিনাজপুরে উদ্ধার
দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, পঞ্চগড়ে নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ আটজনের লাশ দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল সোমবার সকাল থেকে বীরগঞ্জের আত্রাই ও কোতোয়ালির কাঞ্চন নদী থেকে লাশগুলো উদ্ধার করা হয়। এদের মধ্যে রয়েছে তিন শিশু, চার মহিলা ও একজন পুরুষ।
বীরগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত সকোর জানান, আত্রাই নদীর কাশিমনগর বাদলা ঘাট থেকে একটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তার নাম সুব্রত রায় (২)। সে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া গ্রামের প্রফুল্ল রায়ের ছেলে। কোতোয়ালি থানার ওসি তানভিরুল ইসলাম জানান, সকাল ৯টার দিকে দিনাজপুর সদর উপজেলার মাহুদপাড়া পুনর্ভবা নদী থেকে এক যুবকের (২৮) লাশ উদ্ধার হয়। তার পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। তবে এটিও করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজের লাশ বলে ধারণা করা হচ্ছে। খানসামা থানার ওসি চিত্তরঞ্জন জানান, আত্রাই নদীর জিয়া সেতুর কাছ থেকে চারটি নারী ও দুইটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়।


৫ লাশ দেবীগঞ্জে উদ্ধার
দেবীগঞ্জ (পঞ্চগড়) সংবাদদাতা জানান, করতোয়ায় নৌকাডুবির ঘটনায় এখনো নিখোঁজদের উদ্ধারকাজ অব্যাহত রয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে লাশ ভেসে উঠার ও উদ্ধারের খবরও পাওয়া গেছে। গতকাল সোমবার নিখোঁজদের মধ্য থেকে ভোরে দেবীগঞ্জে করতোয়া সেতুর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে দুইজন, টোপকাচারী ঘাটে একজন ও শিবেরহাটে একজনের এবং সুন্দর দীঘি বটতলী থেকে আরেকজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement