২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মিয়ানমার যুদ্ধবিমানের গোলা পড়ল বান্দরবানের সীমান্তে

সর্বোচ্চ সতর্কতা, আবারো তলব করা হচ্ছে রাষ্ট্রদূতকে; আরাকান আর্মির আক্রমণের জেরে জান্তার বিমান হামলা
নাইক্ষ্যাংছড়ি সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও মর্টার শেল ছোড়া হয় : ইন্টারনেট -

মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দু’টি গোলা এসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়েছে। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকায় গোলা দু’টি পড়ে। ঘটনার পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থানে আছে এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এ ঘটনায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকর্তাদের ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানাবে বলে জানিয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) এক কর্মকর্তা। গতকাল বিকেলে ঘটনার সত্যতা জানিয়েছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এর আগে ২৮ আগস্ট বেলা ৩টার দিকে মিয়ানমার থেকে নিক্ষেপ করা দু’টি মর্টার শেল অবিস্ফোরিত অবস্থায় ঘুমধুমের তমব্রু উত্তর মসজিদের কাছে পড়ে।
বান্দরবান জেলা পুলিশ সুপার মো: তারিকুল ইসলাম বলেন, সীমান্তে টহল বাড়ানোর পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত ১০-১২ দিন ধরে সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় মিয়ানমারের অভ্যন্তরে গোলাগুলি হচ্ছে। এই ঘটনায় প্রথম দিকে তমব্রু এলাকার বাংলাদেশ সীমান্তের অংশে থাকা রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা আতঙ্কে থাকলেও বর্তমানে তাদের আতঙ্ক কিছুটা কেটেছে।
এ দিকে বিষয়টি নিয়ে বিজিবির সাথে আলোচনা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি। তিনি বলেন, গোলা পড়ার ঘটনায় বিজিবি সতর্ক অবস্থানে আছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সাথেও আলোচনা হয়েছে। জেলা প্রশাসনসহ সবাই সতর্ক অবস্থানে আছে।
বিজিবি সদর দফতরের পরিচালক (অপারেশন্স) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, শনিবারও মিয়ানমার থেকে ছোড়া গোলা বাংলাদেশে অভ্যন্তরে এসে পড়েছে বলে শুনেছি। আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। ঘটনাটি সত্য প্রমাণিত হলে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো হবে। এর আগেও মর্টার শেল উড়ে আসার ঘটনায় আমরা কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছি। সীমান্তের লোকজন যাতে ভয়ে না থাকে সেজন্য বিজিবি কাজ করছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সকাল সাড়ে ৯টার সময় নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তের রেজু আমতলী বিজিবি বিওপির আওতাধীন সীমান্ত পিলার ৪০-৪১-এর মাঝামাঝি স্থানে মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে সেনাবাহিনীর দু’টি যুদ্ধবিমান এবং দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টার টহল দেয়। সে সময় তাদের যুদ্ধবিমান থেকে প্রায় ৮-১০টি গোলা ছোড়া হয়। এ ছাড়া হেলিকপ্টার থেকেও আনুমানিক ৩০ থেকে ৩৫টি গুলি করতে দেখা যায়। যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দু’টি গোলা সীমান্ত পিলার ৪০ বরাবর আনুমানিক ১২০ মিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পড়ে। স্থানীয়রা জানান, এখনো মিয়ানমারের মুরিঙ্গাঝিরি ক্যাম্প ও তমব্রু রাইট ক্যাম্প থেকে থেমে থেমে মর্টার ফায়ার চলমান রয়েছে। তবে গোলা পড়ার ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, শুক্রবার থেকে দু’টি হেলিকপ্টারকে ওপারে সীমানা ঘেঁষে টহল দিতে দেখা গেছে। এতে রোহিঙ্গা আশ্রয় প্রার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
এ দিকে মিয়ানমারের সীমান্তের ঘটনায় বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। সীমান্ত পেরিয়ে যাতে মিয়ানমারের একজন নাগরিকও বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, সে জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আবদুল মোমেন।
মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে আবারো তলব করা হবে
কূটনৈতিক প্রতিবেদক জানান, সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতে গিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া গোলা এসে পড়ার ঘটনায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে আজ রোববার আবারো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হবে। ইতঃপূর্বে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মর্টার শেল পড়ার ঘটনায় রাষ্ট্রদূতকে দুইবার তলব করা হয়েছিল।
এর আগে গত ২০ ও ২৮ আগস্ট মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল বাংলাদেশে এসে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২১ ও ২৯ আগস্ট মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে প্রতিবাদ জানানো হয়। সীমান্তের ঘটনায় এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতে নতুন করে শরণার্থীদের ঢল ঠেকাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, মিয়ানমারের কোনো উসকানিতে আমরা পা দেবো না।
ফাঁড়িতে আক্রমণের জেরে বিমান হামলা : মিয়ানমারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরাকান আর্মি উত্তর রাখাইন রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তে মংডু টাউনশিপে একটি পুলিশ ফাঁড়ি দখল করার পর জান্তা সরকার বিমান হামলা শুরু করেছে। গত বুধবার আরাকান আর্মি ফাঁড়িটি দখল করে ১৯ জন জান্তা পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে এবং আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম লুট করে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বৃহস্পতিবার সরকার জেট ফাইটার এবং হেলিকপ্টার ব্যবহার করে তিন দফা বিমান হামলা চালায়। একজন বাসিন্দা জানিয়েছেন, সকালে দু’টি বিমান এবং একটি হেলিকপ্টার আক্রমণ করে এবং বিকেলে দু’টি জেট এবং দু’টি হেলিকপ্টার বোমাবর্ষণ করে। সরকার ওই দিন বলেছে যে, তার সৈন্যরা শক্তিবৃদ্ধি এবং কামান ব্যবহার করে ফাঁড়িটি পুনরায় দখল করতে চলেছে।
২ আগস্ট থেকে আরাকান আর্মি সীমান্তসহ ওই এলাকায় আক্রমণ শুরু করার পর পাশের পালেতোয়া টাউনশিপ, চিন রাজ্যে লড়াই শুরু হয়। এএ’র হামলার জেরে সীমান্তের ছয়টি সেনা ঘাঁটি থেকে জেট ও হেলিকপ্টার দিয়ে নিয়মিত বিমান হামলায় প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ শেল নিক্ষেপ করছে জান্তা সরকার। স্থানীয় বাসিন্দারা মংডু শহর এবং পাশের বুথিডাং টাউনশিপে পালিয়ে গেছে।
এএ দাবি করেছে, বুধবার পালেতোয়ার মায়েক ওয়া গ্রামের কাছে একটি লড়াইয়ের সময় ১০ জন জান্তা সৈন্যকে তারা হত্যা করেছে। রাখাইনের সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার বিকেলে ওই রাজ্যের অ্যান টাউনশিপে আরাকান আর্মি একটি জান্তা কনভয়ে অতর্কিত হামলা চালালে বেশ কয়েকজন সেনা নিহত হয়। ভিডিওতে দেখা গেছে একটি সরকারি গাড়ি একটি রাস্তায় জ্বলছে। বর্তমানে জান্তা সারা দেশে প্রতিরোধ বাহিনী এবং জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর হাতে প্রতিদিন আক্রমণের মুখে পড়ছে।
১৫ মাসে দেড় হাজার সেনা নিহত : এ ছাড়া পৃথক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় কায়াহ রাজ্যে ২০২১ সালের মে থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার সেনাসদস্য নিহত হয়েছে। এ ছাড়া এই ১৫ মাসে সরকারি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন দেড় শতাধিক সশস্ত্র প্রতিরোধ যোদ্ধা।
গত বছরের মে থেকে মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে কায়াহতে প্রতিদিনই তীব্র গোলাগুলি, ভারী বিমান ও কামান হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ওই অঞ্চলটিতে ন্যাশনালিটিজ ডিফেন্স ফোর্স (কেএনডিএফ), কারেন আর্মিসহ (কেএ) আরো কয়েকটি প্রতিরোধ গোষ্ঠী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর দাবি, কায়াহ রাজ্যের বেসামরিক নাগরিক এবং প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে টার্গেট করে হামলা চালাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। বর্তমানে কায়াহ থেকে প্রায় ২ লাখ মানুষ বাস্তচ্যুত হয়েছেন। রাজ্যের প্রবেশমুখগুলো বন্ধ করে দেয়ায় খাদ্য সঙ্কট রয়েছে সেখানে।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের নেত্রী সু চিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক বাহিনী। গৃহবন্দী করা হয় সু চিসহ বহু রাজনীতিকদের। সামরিক সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। ক্ষমতা গ্রহণের পর নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি মানুষ।


আরো সংবাদ



premium cement