২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দেশে রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত

-

দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা যেন কাটছেই না। সরকার ও বিরোধী জোটের মধ্যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যে টানাপড়েন চলছিল তা রয়েই গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাসে আগুন, পেট্রলবোমা নেই ঠিকই, তবে অস্বস্তির নতুন নতুন মাত্রা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। দেশজুড়ে বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং, হঠাৎ রাতের আঁধারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ নানামুখী সঙ্কটে দেশের মানুষ ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়ছেন। খরচ কাটছাঁট করে সংসার চালাতে গিয়েও নিম্ন আয়ের মানুষের ত্রাহি অবস্থা। এসব ইস্যুকে ঘিরে গুমোটবাঁধা রাজনীতির মাঠ এখন সরব হয়ে উঠেছে।

এ দিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে শাসক দল আওযামী লীগ ও মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পাল্টাপাল্টি রাজনীতির মাঠ দখলের হুমকি ধমকিতে দেশে সঙ্কটময় পরিস্থিতি আরো ঘণীভূত হচ্ছে। বিবদমান বড় দুই দলের মধ্যে সংলাপ, সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত সেই সঙ্কট থেকে উত্তোরণের কোনো সম্ভাবনাও দেখছেন না রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহল।

তাদের মতে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিএনপি ও তার মিত্রদের দাবিটি দীর্ঘদিনের। এরই মধ্যে গত দুইটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যার প্রথমটি অর্থাৎ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও তার মিত্ররা অংশগ্রহণ করেনি। আবার ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও তার মিত্ররা অংশগ্রহণ করেও শেষমেশ নির্বাচনের দিন বর্জন করে। ওই দাবিকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে জোরালোভাবে মাঠে নেমেছে বিএনপি। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে অন্যান্য ছোটবড় প্রায় সব রাজনৈতিক দল প্রতিদিনই রাজপথে মিছিল সমাবেশ করছে। সম্প্রতি ভোলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে চলা সমাবেশে হামলা চালিয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের দুই নেতাকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। এরপরই রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশ করে মাঠ দখলের হুমকি দিয়েছে বিএনপি ও তার মিত্ররা। আবার রাজনীতির মাঠ দখলে রাখার পাল্টা হুমকি দিয়ে গত বুধবার রাজধানীতে বড় সমাবেশ করে শক্তি দেখিয়েছে সরকারি দল আওয়ামী লীগ। শাসক দল ও সরকারবিরোধী জোটের পাল্টাপাল্টি হুমকিতে রাজনীতিতে আবারো সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে সবখানেই। যার ফলে রাজনৈতিক এই অস্থিরতায় চিঁড়েচ্যাপটা হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষেরা।

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার নয়া দিগন্তকে বলেন, যেসব ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঠে নামছে তা যৌক্তিক। তবে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ালে, সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদল না হলে দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে, যা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আমাদের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তা পিছিয়ে যাবে। ড. মজুমদার বলেন, এসব পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছাতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো সমঝোতাই পৌঁছাতে না পারলে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা থেকেই যাবে, যা দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। আলাপ-আলোচনা বা সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশ সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিএনপিকে চা খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। তার কিছুদিন পরই আমরা দেখতে পেলাম ভোলায় বিএনপির সমাবেশে পুলিশের হামলায় দুইজন নিহত হয়েছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। ড. মাসুম বলেন, বিরোধী দল কোনো আন্দোলন করলেই সরকার দমনপীড়ন করে। এখন বিরোধী দলের সাথে সাধারণ জনগণও যোগ দিয়েছেন। ফলে সরকার বুঝতে পেরেছে তারা আর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। এ জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে আন্দোলন দমন করার জন্য। প্রথমত, সরকার বিএনপির নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি মেনে নিলে রাজনৈতিক সঙ্কট কেটে যাবে। অন্যথায় দেশের সঙ্কট যে মাত্রায় পৌঁছেছে তাতে অনিবার্য পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি নয়া দিগন্তকে বলেন, দ্রব্যমূল্য, জ্বালানি তেলের দাম হঠাৎ করে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং এসব কিছু সাধারণ জনগণের সেন্টিমেন্টের সাথে জড়িত, যা সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব পড়ছে। তিনি আরো বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশ এভাবে চলে না।

রাজনৈতিক অস্থিরতার যে কারণ তার সমাধান সরকারের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু তাদের ক্ষমতা হারানোর ভয় থেকে সমাধান করছে না ফলে সঙ্কট ঘনীভূত হচ্ছে। গোলাম মাওলা রনি বলেন, নানা ধরনের সঙ্কট সরকারকে এখন অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরেছে। সরকারবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ জনগণ এখন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যোগ দিচ্ছে। এসব কারণে সরকারের নৈতিক মনোবলও ভেঙে গেছে। সাধারণ জনগণ বিরোধীদলগুলোর আন্দোলনে যুক্ত হওয়ায় সরকার ইচ্ছে করলেই আর আগের মতো আন্দোলন দমন করতে পারবে না। ফলে সামনের পরিস্থিতিও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো: শামছুল আলম সেলিম নয়া দিগন্তকে বলেন, একটি দেশে গণতান্ত্রিক সরকার না থাকলে, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার না থাকলে এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়ে থাকে। কারণ জনগণের প্রতি এ সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে সবার অংশগ্রহণ, সব মতের প্রাধান্য। দেশের একটি বৃহত্তর অংশকে পাশ কাটিয়ে এভাবে দেশ চালানো সম্ভব নয়। তাই সমঝোতার মাধ্যমে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে কেবল এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণ সম্ভব হবে। অন্যথায় রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে যাবে, অস্থিরতা বাড়বে বৈকি কমবে না।


আরো সংবাদ



premium cement