১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গাজীপুরে নিজস্ব গাড়ি থেকে উদ্ধার হলো শিক্ষক দম্পতির লাশ

স্বজনদের দাবি হত্যা
গাজীপুরে নিজস্ব গাড়ি থেকে উদ্ধার হলো শিক্ষক দম্পতির লাশ -

নিজের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা ও স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখা অবস্থায় মিলল প্রধান শিক্ষককের লাশ। পেছনের সিটেই বসা অবস্থায় পাওয়া যায় তার স্ত্রীর লাশ। গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী বিসিক শিল্প নগরীর শহিদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিয়াউর রহমান মামুন (৫০) ও তার স্ত্রী টঙ্গী আমজাদ আলী পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের সহকারী শিক্ষিকা মাহমুদা আক্তার জলির (৩৫) লাশ গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে তাদের গাড়ির ভেতর এভাবেই পাওয়া যায়। এর আগে বুধবার রাত পৌনে ৭টা থেকে তারা নিখোঁজ হন। বহু খোঁজাখুঁজির পর গতকাল ভোরে গাজীপুর মহানগরীর ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের জয় বাংলা সড়কের বগারটেক এলাকায় একটি প্রতিষ্ঠানের সামনে তাদের গাড়ির সন্ধান পান স্বজনরা। গাড়ির ভেতর থেকে তাদের নিথর দেহ উদ্ধার করে স্থানীয় একটি প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও রাজধানীর উত্তরার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। এর পর স্বজনরা লাশ দু’টি অ্যাম্বুলেন্সে করে জিএমপির গাছা থানায় নেন। সেখানে সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত শেষে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ দু’টি গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় এলাকায় তোলপাড় চলছে। তাদের মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে মাঠে নেমেছে পিবিআই, সিআইডিসহ পুলিশের বিভিন্ন গোয়েন্দা ইউনিট। তবে স্বজনদের অভিযোগ, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
নিহত জিয়াউর রহমানের ছোট ভাই এ কে এম জিয়াউল হক বলেন, এটি পুরোপুরি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তাদের সাথে থাকা স্বর্ণালঙ্কার, দেড় লক্ষাধিক নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন সবই অক্ষত ছিল। যদি ছিনতাইকারী কিংবা দুর্বৃত্তরা এ ঘটনা ঘটাতো তাহলে টাকা, স্বর্ণ, মোবাইলসহ সব কিছু লুটে নিত। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। শুধু তাজা দু’টি প্রাণ নিয়ে গেছে। তবে কেন এবং কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের প্রকাশ্য কোনো শত্রু নেই। তার কোনো অপ্রকাশ্য শত্রু সম্পর্কেও আমাদের জানা নেই। কারোর সাথে তার কোনো বিরোধও ছিল না।
টঙ্গীর শহিদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক নূরুজ্জামান রানা জানান, নিহত জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী মাহমুদা আক্তার জলি বুধবার বিকেল ৪টায় শহিদ স্মৃতি স্কুলে যান। পরে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে তারা নগরীর গাছা থানাধীন কামারজুরির বাড়ির উদ্দেশে নিজস্ব গাড়ি নিয়ে স্কুল থেকে রওনা হন। রাতে তাদের নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
নিহত শিক্ষক জিয়াউর রহমানের ছেলে এ কে এম তৌসিফুর রহমান মিরাজ বলেন, বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে বাবার মোবাইলে ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে মায়ের মোবাইলে ফোন দিলে রিসিভ হয়।
এ সময় মায়ের কণ্ঠ ভার ছিল। পরবর্তীতে মা-বাবার কারো ফোন রিসিভ না হওয়ায় রাতে আত্মীয়স্বজনদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেন। ভোররাত ৪টার দিকে গাছা থানার জয়বাংলা সড়কের বগারটেকে তাদের প্রাইভেট কার দেখতে পেয়ে কাছে যান। এ সময় চালকের আসনে বাবা ও পাশেই পেছনের সিটে মাকে নিস্তেজ অবস্থায় পেয়ে প্রথমে তায়রুন্নেছা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও পরে উত্তরার একটি হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত জিয়াউর রহমানের ভগ্নিপতি মাওলানা আব্দুর রশিদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে টঙ্গীর শহিদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন জিয়াউর রহমান। পরে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তিনি এবং স্ত্রী মাহমুদা ব্যক্তিগত গাড়িতে স্কুলে যাওয়া-আসা করতেন।
লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী গাছা থানার এসআই নাদিরুজ্জামান বলেন, নিহত দম্পতির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে শিক্ষিকা জলির নাক দিয়ে ফেনা বের হতে দেখা গেছে।
নিহতের বড়ভাই মো: রিপন ও শ্যালিকা আহমিদা আক্তার লিমা বলেন, নিহতদের গলায় কালো দাগ রয়েছে। তাদের মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল। এলাকায় বা পরিবারে তাদের নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। তবে জিয়াউর রহমানের সাথে সম্প্রতি তার স্কুলের কয়েকজনের মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে বলে জেনেছি।
নিহত জিয়াউর রহমানের বড় ভাইয়ের স্ত্রী সাজেদা বেগম জানান, জিয়াউর রহমানের প্রথম স্ত্রী প্রায় আট বছর আগে ক্যান্সারে মারা যান। এর পর তিনি শিক্ষিকা মাহমুদা আক্তার জলিকে বিবাহ করেন। এই শিক্ষক দম্পতির কোনো সন্তান নেই। জিয়াউর রহমানের আগের সংসারের একমাত্র ছেলে তৌসিফুর রহমান মিরাজ সাভার মির্জা নগর গণস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
নিহত জিয়াউর রহমানের বড় ভাই মো: রিপন জানান, ময়নাতদন্ত শেষে টঙ্গী শহিদ স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে প্রথম নামাজে জানাজা ও পরে নগরীর ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের কামারজুরি এলাকায় দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে লাশ দু’টি তাদের ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার দড়ি কাঁঠাল গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হবে।
এদিকে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের ও পিবিআই সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সিআইডি সদস্যরা গাড়ি থেকে খাবারের প্যাকেট, টিফিন ক্যারিয়ারে খাবারের উচ্ছিষ্টসহ বেশ কিছু আলামত সংগ্রহ করেছেন। খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হতে পারে বলে স্বজনদের দাবি।
এ ব্যাপারে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার (অপরাধ) মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ বলেন, ঘটনা তদন্তে এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। বিষয়টি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না। মামলা প্রক্রিয়াধীন আছে।


আরো সংবাদ



premium cement