২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

এই মৃত্যুর দায় কার

গার্ডারচাপায় নিহতদের পরিবারে মাতম, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা
-

এতগুলো মৃত্যুর দায় কে নেবে। মৃত্যুর আগে নিদারুণ কষ্ট পাওয়া তিন বছরের শিশুর আর্তনাদের দায় কার। ভাবতে পারছি না ব্যস্ততম রাস্তায় নিরাপত্তাব্যবস্থা না নিয়ে এত বড় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে কিভাবে। কান্নাজড়িত কন্ঠে প্রশ্নগুলো করছিলেন প্রাইভেট কারে বেঁচে যাওয়া নতুন বর হৃদয়। তিনি বলেন, অন্য গাড়িগুলোর মতো তাদের গাড়িও রাস্তা দিয়ে চলছিল। ঝুঁকি নেই দেখেই তো সেখানে যানবাহন চলাচল করতে দেয়া হয়েছিল। তাহলে আমাদের গাড়ির উপর গার্ডার পড়ল কেন? গার্ডারটি যদি কোনো বাসের উপর পড়ত তাহলে কতগুলো মানুষের মৃত্যু হতো। পুত্রবধূকে নিয়ে আনন্দিত বাবা নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। সেই বাবাকে আমি কোথায় পাবো। গতকাল মঙ্গলবার বাবাসহ অন্য স্বজনদের লাশের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে এভাবেই বিলাপ করছিলেন হৃদয়।
গত সোমবার বিকেলে জসীমউদ্দীন রোডের আড়ংয়ের পাশে এই দুর্ঘটনা ঘটে। এতে টয়োটা কোম্পানির এলিয়ান মডেলের গাড়িটি (ঢাকা মেট্রো-গ-২২-৬০০৮) দুমড়ে-মুচড়ে যায়। পরে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা প্রায় তিন ঘণ্টা চেষ্টা করে গাড়ির ভেতর থেকে পাঁচটি লাশ উদ্ধার করে। নিহতরা হলেন- আইয়ুব আলী হোসেন রুবেল (৫৫), ফাহিমা আক্তার (৩৮), ঝরনা আক্তার (২৭), জান্নাতুল (৬) ও জাকারিয়া (৪)। তবে ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় একই গাড়িতে থাকা হৃদয় (২৬) ও রিয়া মনি (২১) নামের নবদম্পতি বেঁচে যায়। স্বজনরা জানান, রুবেল নতুন বরের বাবা। ফাহিমা হলেন নববধূ রিয়া মনির মা। আর ঝরনা তার খালা। জান্নাত ও জাকারিয়া ঝরনার সন্তান। ফাহিমা-ঝরনাদের বাড়ি জামালপুরের ইসলামপুরে। আর রুবেলের বাড়ি মেহেরপুরে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, একটি ক্রেন দিয়ে গার্ডারটি উপরে উঠানো হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই ক্রেনটি কাত হয়ে পড়ে। এতে গার্ডারটি রাস্তায় চলমান প্রাইভেট কারের উপর পড়লে সেটি দুমড়ে-মুচড়ে ভতরে থাকা যাত্রীরা মারা যায়।
পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে শোকে স্তব্ধ নবদম্পতি। মঙ্গলবার সকালে উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হয় তাদের। সেখান থেকে হৃদয় চলে যান মর্গে লাশ গ্রহণের জন্য।
আর রিয়া মনিকে দক্ষিণখানে এক আত্মীয়ের বাসায় রাখা হয়। পায়ে আঘাত পাওয়ায় তাকে রেস্টে থাকতে বলা হয়েছে।
এ দিকে মর্গের সামনে যেন শোকের মাতম চলছিল। গাড়িতে থাকা সব থেকে ছোট শিশুটির মৃত্যুর করুণ বর্ননা দিতে গিয়ে কান্না ধরে রাখতে পারছিলেন না কেউ। এমনকি যারা ওই ঘটনা শুনছিলেন তারা সান্ত্বনা দিতে গিয়ে উল্টো নিজেরাই কাঁদতে শুরু করেছিলেন। এ দিকে ঘটনার পর বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের সব কাজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ক্রেন দুর্ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক রিপোর‌্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির বিষয়টি উঠে এসেছে। এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ ও র‌্যাব বলছে, জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।


মর্গের সামনে হৃদয় বলেন, গত শনিবার তাদের বিয়ে হয়েছে। সোমবার বৌভাত শেষ করে তারা শ্বশুরবাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। ঘটনার বর্ণনায় দিতে গিয়ে হৃদয় বলেন, এয়ারপোর‌্য রোডে ক্রেনে একটা বক্স গার্ডার ঝুলছিল। আমরা দূর থেকে এটা দেখেছি। একের পর এক গাড়ি গার্ডারের পাশ দিয়েই চলে যাচ্ছিল। আমরা ভাবলাম, আমরাও যেতে পারব। যখনই পার হতে গেলাম তখনই গার্ডারটা গাড়ির উপরে পড়ল। আমি বাবার বাম পাশে ছিলাম, আমার স্ত্রী পেছনের সিটে বাম পাশে ছিল। ডান পাশে আমার বাবাসহ বাকিরা ছিল। ডান পাশে যারা ছিল তারা সবাই সেখানেই মারা যায়। তিনি আরো বলেন, ঘটনার সময় তার পা আটকে গিয়েছিল; কিন্তু আশপাশের লোকজন প্রায় ১০ মিনিট চেষ্টা করে তাকে বের করেন। তার স্ত্রী রিয়া মনিও আটকে গিয়েছিল। তাকে বের করতে ৩০ মিনিটের বেশি সময় লেগেছে। কিন্তু বাকি কাউকে আর বের করতে পারিনি।
সজীব হোসেন নামে অপর একজন বলেন, জাকারিয়া নামের শিশুটা ওর মায়ের কোলে ছিল। গার্ডারের চাপ ওর পায়ের উপর পড়েছিল। তার মাথা এবং বুক অক্ষত ছিল। শিশুটি বাঁচার জন্য অনেক কেঁদেছিলা। তার কান্না শুনে আশপাশের পথচারীরাও কাঁদছিলেন। কাঁদছিলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্যও। ছোট্ট শিশুটি বারবার বলছিল ‘আমার ব্যথা করছে, আমাকে বের করো, এরপর সে পানি খাওয়ার জন্য কাঁদছিল; কিন্তু তাকে এক ফোঁটা পানি দেয়ার অবস্থা ছিল না। গার্ডার এমনভাবে ওর পায়ের উপর পড়েছিল যে বের করা সম্ভব হচ্ছিল না। হয়তো পা কেটে ফেললে শিশুটিকে বাঁচানো যেত।
এ দিকে গার্ডারের চাপায় প্রাইভেট কারে থাকা শিশুসহ নিহত পাঁচজনের লাশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৫টায় তিনটি ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে হৃদয়ের বাবা রুবেলের লাশ নিতে তার স্ত্রী পরিচয়ে সাত নারী হাজির হন মর্গে। তারা প্রত্যেকেই নিজেকে রুবেলের স্ত্রী দাবী করেন। এই নিয়ে চরম ঝামেলায় পড়ে যায় মর্গ কর্তৃপক্ষ। অবশেষে কোনো স্ত্রীর কাছে লাশ না দিয়ে নিহতের ছেলে হৃদয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
হৃদয় বলেন, আমার বাবার লাশ আমি বুঝে পেয়েছি। লাশ নিয়ে এখান থেকে প্রথমে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর যাবো। সেখানে নামাজে জানাজা শেষে মেহেরপুরে নিজ গ্রামে দাদা-দাদীর কবরের পাশে দাফান করা হবে। এ দিকে নিহত ঝরনা আক্তারের ভাই মনির হোসেন জানান, আমার দুই বোন ও এক ভাগ্নি-এক ভাগ্নের লাশ বুঝে পেয়েছি। লাশগুলো গ্রামের বাড়ি জামালপুরে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে নামাজে জানাজা শেষে দাফন করা হবে।


এ দিকে উত্তরায় নির্মাণাধীন বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের ক্রেন দুর্ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রাথমিক রিপোর‌্যে চায়নার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির বিষয়টি উঠে এসেছে। সড়ক সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী সাংবাদিকদের বলেন, প্রতিবেদন অনুযায়ী এই দুর্ঘটনার মূল দায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। তারা কাউকে না জানিয়ে ব্যস্ততম রাস্তায় কাজ করছিল। অথচ ওই দিন ১৫ আগস্টে কাজ বন্ধ থাকার কথা ছিল। চুক্তি অনুযায়ী এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। এ ব্যাপারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে তার আগে বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে উত্থাপন করা হবে। সেখানে আরো কারো দায় আছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। এর আগে গত সোমবার রাতে উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন দুর্ঘটনায় পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আরবান ট্রান্সপোর‌্য অনুবিভাগ) নীলিমা আখতারকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও দু’দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা বলা হয়।
এই ঘটনায় নিহত ফাহিমা আক্তার ও ঝরনা আক্তারের ভাই মো: আফরান বাবু বাদি হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করেন। সেখানে নিহতরা কিভাবে প্রাইভেট কারের ভেতর চাপা অবস্থায় ছিল তার রোমহর্ষক বর্ণনা দেয়া হয়। মামলার বিবরণীতে বলা হয়েছে, নিহত আইয়ুব আলী হোসেন ওরফে রুবেলের শরীর ও মুখমণ্ডল থেঁতলে যায়। তার নাক দিকে রক্ত নির্গত হতে থাকে। বুক, পেট, পিঠ, হাত ও পায়ের বিভিন্ন স্থানে কালচে জখম ছিল। ফাহিমা আক্তারের মাথা থেঁতলানো ও চ্যাপ্টা ছিল। ঘাড় ভাঙা ও বুক-পেটের চামড়া উঠে গিয়েছিল। বাম হাত ও কোমরের ডান পাশ ভাঙা, বাম হাঁটুর নিচে হাড় থেকে মাংস আলাদা হয়ে যায়।
ঝরনা আক্তারের মাথা থেঁতলানো ও মগজ বিছিন্ন হয়ে যায়। ঘাড় ভাঙা, বুক থেঁতলানো ও চামড়া উঠে গিয়েছিল। পেট-পিট থেঁতলানো ও মোচড়ানো ছিল। এ ছাড়া দু’হাত ভাঙা, দু’পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে থেঁতলে যায়। শিশু জান্নাতুলের মুখমণ্ডল-মাথা থেঁতলানো ও চ্যাপ্টানো ছিল। ঘাড় ও বুকের পাঁজর ও ডান হাত ভাঙা ছিল। আরেক শিশু জাকারিয়ার শরীরের বাম পাশ চ্যাপ্টানো ও জখমপ্রাপ্ত ছিল। নাক দিয়ে নালা নির্গত হচ্ছিল।
মামলায় অবহেলাজনিত কারণে ক্রেন পরিচালনাকারী চালক, প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মোহাম্মদ মোহসীন বলেন, উত্তরায় ক্রেন দুর্ঘটনায় নিহত দুই বোনের ভাই বাদি হয়ে মামলা করেছেন। ঘটনাটি গুরুত্বসহকারে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। জড়িতদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান চলছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement
শ্যালকদের কোপে দুলাভাই খুন : গ্রেফতার ৩ তীব্র গরমে কী খাবেন আর কী খাবেন না এবার তালতলী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে বললেন এমপি জয় পঞ্চপল্লীর ঘটনায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে যা দরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার নির্দেশ সরকার ভিন্ন মত ও পথের মানুষদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে : মির্জা ফখরুল ধুনটে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে বৃদ্ধের মৃত্যু বাকৃবির এক্স রোটারেক্টরর্স ফোরামের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠিত পাবনায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড, হিট স্ট্রোকে মৃত্যু ১ দাগনভুঞায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তির ঘটনায় আ’লীগ নেতাকে শোকজ দখলে থাকা ৪ গ্রাম আজারবাইজানকে ফিরিয়ে দেবে আর্মেনিয়া

সকল