২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
জ্বালানি তেল, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও লোডশেডিংয়ে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়

মূল্যস্ফীতিতে পিষ্ট মানুষ

-

জ্বালানি তেলের ভয়াবহ দাম বৃদ্ধি ও ডলারের উল্লম্ফনে বাড়ছে পণ্যের আমদানি ব্যয়। সেই সাথে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কারণে স্থানীয় বাজারে সব পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। এতে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল, ডাল, ভোগ্যপণ্যসহ সবধরনের পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আয় বাড়েনি, কিন্তু ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় দিশেহারা ভোক্তারা। বিশেজ্ঞরা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে ভোক্তাদের খাদ্য রেশনিং করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। নিজে থেকেই তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা খেতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অব্যবস্থাপনা, জ্বালানির আমদানি নির্ভরতা ও বৈশ্বিক অবস্থার কারণে বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে, নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনে যতটুকু না সরকার মনোযোগী হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি মনোযোগী ছিল জ্বালানি আমদানিতে। চাহিদার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে সাশ্রয়ী ও টেকসই জ্বালানি নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে একদিকে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করে ভর্তুকি বাড়ানো হচ্ছে, অপরদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখেই বছরের পর বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পরিশোধ করা হয়েছে।
এক পরিসংখ্যান মতে, গত ১২ বছরে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যয় অনেকটা অপচয় মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আর এর দায় চেপেছে জাতির ঘাড়ে। এ কারণে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে প্রায় ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আর জ্বালানি তেলের ওপর ভর্তুকি কমাতে ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে কয়েকটি এলএনজি চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। পাশাপাশি কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সবমিলেই সারা দেশে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে গেছে।
লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বড় বড় শিল্পকারখানা ডিজেলচালিত জেনারেটর দিয়ে লোডশেডিংয়ের সময় উৎপাদন চালু রাখা হচ্ছে। এতে ক্ষেত্রবিশেষ কোনো কোনো কারখানার উদ্যোক্তার দিনে দুই থেকে তিন লাখ টাকার ব্যয় বেড়ে গেছে। তবে, ছ্টো ছোট শিল্প উদ্যোক্তারা পড়েছেন বিপাকে। তাদের জেনারেটর চালানোর মতো সক্ষমতা নেই। তাই লোডশেডিংয়ের সময় তাদের উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কিন্তু দিন শেষে শ্রমিকের মজুরি ঠিকই পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে তাদের ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়ছে ভোক্তা পর্যায়ে। ভোক্তা পর্যায়ে সবধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। কারণ, শুরুতেই যখন ঘাটতি ছিল তখন এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা ঠিক ছিল। কিন্তু এখন চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক বেড়েছে। এ সময় এসব উচ্চমূল্যের রেন্টাল বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা মোটেও ঠিক নয়।
তিনি মনে করেন, জ্বালানি তেলে ট্যাক্স কমিয়ে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা যেতো। তা না করে রাতারাতি অস্বাভাবিক হারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়েছে পণ্যের ওপর। এখন এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভোক্তাদের কম ভোগ করা ছাড়া বিকল্প নেই। সাধারণ মানুষকে তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা খেতে হবে। ভোক্তাদের পক্ষ থেকে মূল্যস্ফীতি কমানোর আর কোনো উপায় নেই বলে তিনি মনে করেন।


বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, অপ্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় না কমালে ডলারের চাহিদা কমবে না। ডলারের চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে পণ্যের আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যেত। তিনি বলেন, এক দিকে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে, সেই সাথে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে সাধারণের দুর্ভোগ অসহনীয় আকারে দেখা দিয়েছে। মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে জ্বালানি তেলের আমদানিতে বাড়তি কর কমিয়ে তেলের দাম কমানো যাবে। এতে কিছুটা হলেও দুর্ভোগ লাঘব হবে সাধারণ জনগণের।
ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। যেমন, প্রতি ডলার ৯৪ টাকা মূল্য ধরে পণ্যের এলসি খোলা হয়েছিল মাস দেড়েক আগে। যখন পণ্য দেশে এসেছে তখন প্রতি ডলারের জন্য পরিশোধ করতে হচ্ছে ১১৪ টাকা। তা-ও চাহিদা অনুযায়ী ডলার সংস্থান করতে পারছে না ব্যাংক। এখানেই প্রতি ডলারের জন্য তাদের বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে ২০ টাকা। এর সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করার প্রভাব। একসাথে প্রায় ৫১ শতাংশ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে উৎপাদন পর্যায়ে। সাথে শুরু হয়েছে লোডশেডিং। লোডশেডিংয়ের কারণে জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে জ্বালানি তেল পোড়াতে হচ্ছে। আর এতে বেড়ে যাচ্ছে সামগ্রিক ব্যয়। একজন উদ্যোক্তা জানান, এসব কারণে প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন ব্যয় ৫০ শতাংশ থেকে শতভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া। এতে পণ্যের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছে মানুষ। ফলে লোকসান কমাতে শ্রমিক ছাঁটাইসহ কারখানার ব্যয়ও কমিয়ে আনতে হচ্ছে।
ব্যাংকারররা জানিয়েছেন, এমনিতেই একশ্রেণীর উদ্যোক্তা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে টালবাহানা করেন, এর সাথে নতুন করে জ্বালানি তেল ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে অনেক প্রকৃত উদ্যোক্তাও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারাবে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
এ দিকে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরম আকারে পৌঁছেছে। কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। গত ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ছিল যেখানে ৬.০৫ শতাংশ, সেখানে মার্চে ৬.২২ শতাংশ, জুনে এসে আরো বেড়ে হয় ৭.৫৬ শতাংশ এবং জুলাইয়ে এসে ৭.৪৮ শতাংশ হয়। যদিও বাস্তবের সাথে এর তেমন কোনো মিল নেই বলে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন। তাদের মতে, গত এক মাসে সব ধরনের পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। চাল থেকে শুরু করে সবধরনের পণ্যের দাম কেজিতে ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গত মাসে ডিমের ডজন যেখানে ১২০ টাকা ছিল চলতি মাসে তা বেড়ে হয়েছে দেড় শ’ টাকা ওপরে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, সামনে বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অপর দিকে একটি নির্দিষ্টসংখ্যক মানুষের আয় নির্ধারিত। বরং অনেক প্রতিষ্ঠান মাসের বেতন মাসে পরিশোধ করতে পারছে না। এই মুহূর্তে ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের সামনে খাবার রেশনিং করা ছাড়া আর কোনোই বিকল্প নেই বলে মনে করছেন তারা।

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement