২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ক্ষমতায় গেলে ১২ দফা বাস্তবায়ন

জ্বালানি দুরবস্থার মূলে দুর্নীতি ও আত্মঘাতী চুক্তি : বিএনপি

-

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বর্তমান অবস্থার জন্য সরকারের ‘সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, আত্মঘাতী চুক্তি ও অপরিণামদর্শী পরিকল্পনা’কে দায়ী করেছে বিএনপি।
একসাথে আগামীতে ক্ষমতায় গেলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবারহ দ্রুত বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানির চুক্তি বাতিলসহ ১২ দফা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা তুলে ধরেছে দলটি।
গতকাল শনিবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চিত্র তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি আর হরিলুটের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। এখন শহরে দুই-তিন ঘণ্টা এবং গ্রামাঞ্চলে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা লোডশেডিং জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এক দিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে, বিদ্যুতের লোডশেডিংজনিত জনদুর্ভোগ মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে যুক্ত হয়েছে। মানুষ দিশেহারা হয়ে উঠেছে, তাতে তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।
ব্যর্থতার জন্য সরকারের পদত্যাগ দাবি পুনর্ব্যক্ত করে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা বিদ্যুৎ খাতের এই বিপর্যয়, রিজার্ভের সঙ্কট সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক নৈরাজ্য ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাসের দায় নিয়ে বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকারকে অবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে দুর্বার আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণই এই সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করবে।


‘ক্ষমতায় গেলে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বাতিল’ : বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা বিদ্যুতের এই সমস্যার সমাধান করব। আশার বাণীটা বলি- আমরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবারহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনসহ সকল কালা কানুন বাতিল করব। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল কোম্পানির সাথে সব চুক্তি বাতিল করা হবে। স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা মূলত আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও অন্যান্য কাজ সম্পাদন করা হবে।
চাহিদা অনুযায়ী পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। উৎপাদনের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন অতিদ্রুত স্থাপন করা হবে। বাপেক্সে ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার মাধ্যমে দেশীয় খনিজ ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। একই সাথে দেশীয় প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ করে তুলতে উপযুক্ত উদ্যোগ নেয়া হবে।
এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরে সম্ভাবনাময় গ্যাস/ পেট্রলিয়াম ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উত্তোলনে দ্রুত কাযর্কর ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দুর্নীতি-অনিয়মের সাথে জড়িতদের শাস্তি, জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমিয়ে ক্রমান্বয়ে মোট উৎপাদনের ৫০ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি নির্ভর জ্বালানি নীতি গ্রহণ, বেইস লোড পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন গড়ে তোলা, বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর সংস্কার এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ঘোষিত ভিশন-২০৩০ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার কথা তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব।


ক্যাপাসিটি চার্জ : গচ্ছা ৯০ হাজার কোটি টাকা : মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ১৯টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট চালুর দুই-তিন বছর পরই বন্ধ হওয়ার কথা থাকলেও প্রয়োজন ছাড়াই এখনো চালু আছে। বেশ কিছু রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি ট্যাক্স বাবদ বিপুল অর্থ নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ ছাড়াই সরকারকে এই পর্যন্ত ৯০ হাজার কোটি টাকার গচ্ছা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব ব্যবসায়ীদের পকেটেই গেছে ৬০ হাজার কোটি টাকা। গত ১২ বছরে ক্যাপাসিটি ট্যাক্স বাবদ গেছে প্রায় ৮ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। গত তিন বছরেই গেছে ৫৪ হাজার কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জ অযৌক্তিক, অনৈতিক, জনস্বার্থ বিরোধী ও অপরাধ।
তিনি বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা সঠিকভাবে নির্ধারণ না করে চাহিদার অনেক বেশি পাওয়ার প্ল্যান্টের সাথে চুক্তি করে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ীদের অর্থ লুট করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই সরকারের নীতি একটাই তা হচ্ছে জনগণের সম্পদ লুট করে নিজের সম্পদ বৃদ্ধি করা এবং বিদেশে সেই সম্পদ পাচার করা।
‘অলস কেন্দ্র’ : মির্জা ফখরুল বলেন, বর্তমানে দেশে মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাত্র ৪৩ শতাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। অবশিষ্ট ৫৭ শতাংশ অলস বিদ্যুৎ বসিয়ে রেখে কেন্দ্রের ভাড়া দেয়া হচ্ছে।


বিদ্যুৎ না কিনে গত অর্থবছরে বিল পরিশোধ করা হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা, তার আগের বছর করা হয়েছে ১৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। গত অর্থ বছরে এই খাতে ব্যয় হয়েছে ২১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়ে হয়েছে ১৮ শতাংশ। ক্রমেই ক্যাপাসিটি চার্জের বিল বেড়েই যাচ্ছে।
তিনি বলেন, এখানেই শেষ নয়। বর্তমানে বাড়তি উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে আরো বিদ্যুৎকেন্দ্র আসছে। এতে অলস খরচ আরো বাড়বে। বর্তমানে ১৩ হাজার ৩৮৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৫টি কেন্দ্র নির্মাণাধীন। ২০২৬ সালের মধ্যে এসব কেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে ৩ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক উৎপাদনে আসতে পারে। নির্মাণাধীনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেসরকারি খাতে রয়েছে ৯ হাজার মেগাওয়াট। এই কেন্দ্রগুলোর উল্লেখযোগ্য গ্যাসভিত্তিক। এখনই গ্যাস সঙ্কটে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। আগামী চার বছরে আরো ১৩ হাজার মেগাওয়াটের কেন্দ্র উৎপাদনে এলে বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়বে। সব মিলে বিদ্যুৎ না কিনেও অতিরিক্ত টাকা পরিশোধের অঙ্ক অনেক গুণ বেড়ে যাবে।
সরকার টাকা চুরির স্বার্থে মাল্টি ফাইন্যান্স ইনস্টিটিউটের কম সুদের ঋণ উপেক্ষা করে পারস্পরিক স্বার্থে উচ্চ সুদের ‘বাইলেটারাল লোন’ বেশি আগ্রহী’।
সামিট গ্রুপ, অ্যাগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল, এরদা পাওয়ার হোল্ডিং, ইউনাইটেড গ্রুপ, কেপিসিএল, বাংলা ক্যাট, ওরিয়ন গ্রুপ, হোসাফ গ্রুপ, মোহাম্মদী গ্রুপ, ম্যাক্স গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও এপিআর এনার্জি এই কোম্পানিগুলো কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে অর্থ নিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, কুইক রেন্টালের নামে হয়েছে কুইক লুটপাট।


‘ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি কেন’ : মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ভারত থেকে বিদ্যুৎ কিনতে দিতে হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ। ভারত থেকে বর্তমানে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এ জন্য গত তিন অর্থবছরে প্রায় ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। আদানি গ্রুপের ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির কথা রয়েছে। বাংলাদেশে যখন প্রায় ৬০ শতাংশ ওভার ক্যাপাসিটি রয়েছে ঠিক সে সময় ভারত থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ আমদানি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ১৬০০ মেগাওয়াটের আদানি গোড্ডা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ বছরে প্রায় ১১.০১ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করবে। এই বিদ্যুৎ আমদানির ৪০ শতাংশ যায় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে।


‘জনগণের ওপর বোঝা চাপানো’ : মির্জা ফখরুল বলেন, গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা বৃদ্ধি না করে আইপিপির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা অন্যায়ভাবে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দশ বছরে অফশোর গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাবনাকে কাজে লাগায়নি। এমনকি বিদ্যমান গ্যাস ফিল্ডের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের মাধ্যমেও বর্তমান পরিস্থিতিতে ২০ শতাংশের বেশি গ্যাস সরবরাহ করা যেত, তাও করা হয়নি।


পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রসঙ্গে : মির্জা ফখরুল বলেন, এই অদূরদর্শী পরিকল্পনার টিপ অব দ্য আইসবার্গ হচ্ছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দৃষ্টান্ত। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে গেলেও সঞ্চালন লাইনের নির্মাণ শেষ না হওয়ায় কেন্দ্রটি সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। কিন্তু কোনো বিদ্যুৎ না দিলেও এ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে চীনা ঋণে বাস্তবায়নাধীন পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো- সঞ্চালন লাইনের কাজটি সম্পন্ন করা হলো না কেন? বিদ্যুৎ না কিনেও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা কেন পরিশোধ করা হলো? অনেকেই মনে করেন ইচ্ছাকৃতভাবে বিদ্যুৎ না কিনেও যোগসাজশে অর্থ লুটের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
বিএনপির শাসনামলে স্বচ্ছ ক্রয় প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে সরকারি ক্রয়নীতিমালা প্রণয়নের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব।
সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের সময়ে আমরা যে প্রিপেইড মিটার আমদানি করেছিলাম সিমেন্সের কাছ থেকে এবং বুয়েট থেকে বানিয়েছিলাম। সেখানে ১০ শতাংশ রেয়াত সুবিধা দেয়া হয়েছিল। ওরা (বর্তমান সরকার) এসে ওই সব ফেলে দিয়েছে। ওই মিটারগুলো এখন নাই। এখন ওরা যে প্রোগ্রামিং করে মিটারগুলো এনেছে, সেই মিটারগুলো লাগানো হয়েছে। আমার মিটারে ১১৫ টাকা ছিল। আমি ১০০০ টাকা ভরেছি। তাহলে ১১৫০ টাকা থাকার কথা। কিন্তু আমি দেখলাম আমার মিটারে আমি বিদ্যুৎ কিনতে পারব ৯৩০ টাকা। এভাবে ওরা লুট করছে, প্রযুক্তি দিয়ে মানুষের অর্থ লুট করছে।
সংবাদ সম্মেলনে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement