২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজনীতিতে জ্বালানির উত্তাপ

রাজনীতিতে জ্বালানির উত্তাপ -

এমনিতেই দীর্ঘ দিন থেকেই ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং মানুষকে চরম ভোগান্তিতে ফেলে দিয়েছে। আবার রাতের আধারে হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে এর প্রভাব পড়েছে সবখানেই। ফলে এসব নানামুখী সঙ্কটে মানুষের জীবন অনেকটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এসব ইস্যুকে ঘিরে দীর্ঘ দিন ধরে নিষ্ক্রিয় থাকা রাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং তার সমর্থিত দুয়েকটি শরিক দল ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দলই এখন মাঠে নেমেছে। প্রতিদিনই ভয়াবহ লোডশেডিং, জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশেষ করে এসব ইস্যুকে সামনে রেখে দীর্ঘদিনের নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিএনপি ও তার মিত্রদের দাবির আন্দোলন এখন জোরালো হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন দেশের রাজনৈতিক বোদ্ধারা।

এ দিকে সরকারবিরোধী আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও মাঠে নামার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। আপাতত ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার প্রতিবাদে রাজধানীতে বড় ধরনের সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করবে দলটি। এ মাসটি শাসকদল শোকের মাস হিসেবে পালন করায় কিছুটা নমনীয় রয়েছে। আগামী মাস সেপ্টেম্বর থেকে জোরালোভাবে মাঠে নামতে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে ক্ষমতাসীনরা। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিএনপি রাজপথ দখল করার ঘোষণা দিয়েছে। আমি নেতাকর্মীদের অনুরোধ জানাই, এটি শোকের মাস। শোকের মাস হিসাবে নানান কর্মসূচি আমরা পালন করছি। সেপ্টেম্বরে আমরা মাঠে নামব। রাজপথ আমাদের দখলে থাকবে। তিনি আরো বলেন, আমরা রাজপথ দখলে রাখব আগামী মাস থেকে। কোনো দুষ্কৃতকারী যাতে মানুষের ওপর হামলা পরিচালনা করতে না পারে। বিএনপি নামধারী, বিএনপির ব্যানারে দুষ্কৃতকারীরা আবার যাতে মানুষের ওপর হামলা করতে না পারে, জিম্মি করতে না পারে, পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করতে না পারে সে জন্য আগামী মাস থেকে নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথ আমরা দখলে রাখব।

রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, যেসব ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মাঠে নামছে তা যৌক্তিক। তবে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ালে, সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদল না হলে দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে, যা মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আমাদের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তা পিছিয়ে যাবে। ড. মজুমদার বলেন, এসব পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলো আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছাতে পারে। সর্বোপরি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো গেলে দেশের জন্য কল্যাণকর হবে।

বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশ সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। সরকার তো কারো কোনো কথার তোয়াক্কা করে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নাগালের বাইরে চলে গেছে। এই যে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের কথা বলা হচ্ছে! এখন তো ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে মানুষের ভোগান্তি চরম মাত্রায় পৌঁছে গেছে। তাহলে গত ১৩ বছর কিসের উন্নয়ন হলো? আসলে এসব বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি বলেন, দেশের মানুষ যখন এসব নিয়ে কথা বলে তখন সরকারের মাথা খারাপ হয়ে যায়। কিছুদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী নিজেই বিএনপিকে চা খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। তার কিছুদিন পরই আমরা দেখতে পেলাম ভোলায় বিএনপির সমাবেশে পুলিশের হামলা। ওই হামলায় দুইজন নিহত হয়েছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। ড. মাসুম বলেন, বিরোধী দল কোনো আন্দোলন করলেই সরকার দমনপীড়ন করে। এখন বিরোধী দলের সাথে সাধারণ জনগণও যোগ দিয়েছে। ফলে সরকার বুঝতে পেরেছে তারা আর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। এ জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে আন্দোলন দমন করার জন্য। কিন্তু সঙ্কট যে মাত্রায় পৌঁছেছে তাতে দেশ অনিবার্য পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

রাজনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি নয়া দিগন্তকে বলেন, দেশে এখন যা হচ্ছে তা সরকার কিংবা বিরোধী দল কারো নিয়ন্ত্রণে নেই। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের দাম হঠাৎ করে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং এসব কিছু সাধারণ জনগণের সেন্টিমেন্ট। তিনি বলেন, দেশে কিছুদিন হলো নতুন নতুন সঙ্কট তৈরি হচ্ছে, যা সাধারণ জনগণের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব পড়ছে। এ রকম আরো অন্তত অর্ধশতাধিক আন্তর্জাতিক সঙ্কট আছে যেগুলোর ইচ্ছে করলেই সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। যেমন- ডলার সঙ্কট আইএমএফ থেকে আরো ঋণ নেয়া, জ্বালানি তেলের দাম কমানো এ রকম কিছু বিষয় আছে যা সরকার ইচ্ছে করলেও সমাধান করতে পারবে না। গোলাম মাওলা রনি বলেন, নানা সঙ্কট সরকারকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরেছে। ওই সঙ্কট থেকে সরকার আর বের হতে পারবে না।

আর সরকারবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ জনগণ এখন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই যোগ দিচ্ছে। এসব কারণে সরকারের নৈতিক মনোবলও ভেঙে গেছে। সাধারণ জনগণ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনে যুক্ত হওয়ায় সরকার ইচ্ছে করলেই আর আগের মতো আন্দোলন দমন করতে পারবে না। সামনের পরিস্থিতিও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল