১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কুশারী পরিবার ভালো নেই

খুলনার পিঠাভোগ রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালার সামনে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি বংশধরের কয়েকজন : নয়া দিগন্ত -

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের বাড়ি খুলনার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগ গ্রামে। কবিগুরুর পূর্বপুরুষ রামগোপাল কুশারী ছিলেন এই গ্রামের অধিবাসী। তবে কুশারীদের আদি বাড়িটি এখন আর নেই। কয়েক বছর আগে প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন ভবনটি ভেঙে ফেলে সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘পিঠাভোগ রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা’। এই স্মৃতি সংগ্রহশালার পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশধর দুই পরিবারের ১৩ জন সদস্য এখনো বসবাস করছেন। সময়ের ব্যবধানে বর্তমানে জীর্ণশীর্ণ বাড়িটুকু ছাড়া আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। অর্থ-বিত্ত আর প্রভাব-প্রতিপত্তির সেই জৌলুস হারিয়ে তীব্র অভাব-অনটন ভর করেছে বিশ^কবির পিঠাভোগ গ্রামের আদি বংশধর কুশারীদের দু’টি পরিবারের সদস্যদের ওপর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষ রামগোপাল কুশারীর ১৭তম বংশধর গোপালচন্দ্র কুশারী জানান, কুশারী বংশের এখনো দু’টি পরিবার পিঠাভোগ গ্রামের আদি ভিটায় মাটি কামড়ে পড়ে আছে। এই ১৩ জনের মধ্যে গোপালচন্দ্র কুশারীর মা ৯৫ বছরের বৃদ্ধা ছায়া রাণী কুশারী বর্তমানে হাঁটাচলা করতে পারেন না। আর মেঝো ভাই গোবিন্দচন্দ্র কুশারী দীর্ঘ দিন ধরে মানসিক প্রতিবন্ধী।
তিনি জানান, রাম গোপাল কুশারীর ছেলে জগন্নাথ কুশারী। এই জগন্নাথ কুশারী বিয়ে করেছিলেন ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামের শুকদেব রায় চৌধুরীর মেয়েকে। এ বিয়ে জগন্নাথ কুশারীকে সমাজচ্যুত করে। প্রতিকূল অবস্থায় পড়ে তিনি তার পিঠাভোগের পৈতৃক নিবাস ছেড়ে ফুলতলার দক্ষিণডিহি গ্রামের শ^শুরালয়ে আশ্রয় নেন। সেখানেই বসত গড়েন জগন্নাথ কুশারী। তার অধস্তন পঞ্চম পুরুষ পঞ্চানন কুশারী জ্ঞাতি কলহের শিকার হয়ে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় চলে যান। কলকাতার গোবিন্দপুরের আদি গঙ্গার পাড়ে এক জেলেপল্লীতে বসতি গড়েন তিনি। ব্রাহ্মণ হওয়ায় জেলেদের কাছে পঞ্চানন কুশারী ছিলেন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তারা তাকে শ্রদ্ধাভরে ডাকত ঠাকুর মশাই। কালক্রমে তিনি ঠাকুর নামেই পরিচিত হয়ে ওঠেন। ব্রাহ্মণ হওয়ার কারণে পিঠাভোগের কুশারী বংশের লোকদেরও স্থানীয়রা ‘ঠাকুর’ বলে সম্বোধন করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বংশের ১৩তম বংশধর ছিলেন।
গোপালচন্দ্র কুশারী বলেন, এক সময় তাদের পূর্বপুরুষদের জমিদারি ছিল। ছিল বিপুল অর্থ-বিত্ত, প্রচুর ভূসম্পত্তি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি। কিন্তু বর্তমানে জীর্ণশীর্ণ বাড়িটুকু ছাড়া আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। অনেক সম্পত্তি দখল হয়ে গেছে। অনেক সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেছে। তিনি জানান, দাকোপ উপজেলার বাজুয়ার ১ একর ৭৬ শতক জমি দখল হয়ে গেছে। তেরখাদার জমি, ফকিরহাটের বৈতলী মৌজার জমিও আর দখলে নেই। সর্বশেষ তার পিতা মানিকলাল কুশারী ও কাকা গৌরমোহন কুশারীর ৮-১০ একর জমি ছিল। তবে এর অধিকাংশ জমি এখন নামে থাকলেও দখলে নেই।
পিঠাভোগের পৈতৃক বাড়িটির জায়গা ছিল ৯ একর ৩৫ শতক জমির ওপর। বর্তমানে আছে মাত্র ৪ বিঘা। বাড়ির পাশে পূর্বপুরুষদের শান বাঁধানো পুকুরটিও আর তাদের নেই। অভাব-অনটনের কারণে পুকুরটিও শরিকরা বিক্রি করে দিয়েছেন। যে জমি দখল হয়ে গেছে তা উদ্ধারেও কেউ সহযোগিতা করে না।
গোপালচন্দ্র কুশারী আরো বলেন, তিনি ও তার স্ত্রী শিল্পী কুশারী রূপসায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের (বিআরডিবি) একটি প্রকল্পে স্বল্প বেতনে চাকরি করেন। দুইজনের সামান্য আয় দিয়ে বৃদ্ধা মা ও ছোট ভাই মানসিক প্রতিবন্ধী গোবিন্দচন্দ্র কুশারীর ওষুধ ও সন্তানের লেখাপড়া করানোসহ সংসার চালাতে ভীষণ কষ্ট হয়। বর্তমানে আমাদের দু’টি পরিবারকে দরিদ্রতা গ্রাস করে ফেলেছে। কিন্তু পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা ভেবে নিজেদের অভাব-অনটনের কথা কাউকে বলতে পারি না। প্রায় প্রতিদিনই ‘পিঠাভোগ রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা’ দেখতে ও আমাদের (রবীন্দ্রনাথের বংশের লোক) সাথে কথা বলার জন্য দেশ-বিদেশের সাংবাদিক-গবেষকরা আসেন। কিন্তু অনেক সময় তাদের এক কাপ চা পান করাতেও পারি না। এটা আমাদের জন্য খুবই কষ্ট ও লজ্জার।
তিনি বলেন, ‘পিঠাভোগ রবীন্দ্র স্মৃতি সংগ্রহশালা’ দেখাশোনা করার জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে তাদের এক ভাই বরুণ কুশারীকে মাসিক মাত্র এক হাজার টাকা সম্মানী দেয়া হয়। তার আরেক কাকাতো ভাই অরুণ কুশারী বাড়ির পাশে একটি জুট মিলে সামান্য বেতনে চাকরি করে। সব মিলিয়ে আমাদের অবস্থা অবর্ণনীয়। অরুণচন্দ্র কুশারীর স্ত্রী সোমা কুশারী বলেন, ১০ বছর আগে যখন আমার এই পরিবারে বিয়ে হয়, তখন জানতাম না বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কুশারী বংশের লোক এবং এই বাড়িটিই তাদের পূর্বপুরুষের বাড়ি। যখন জানলাম তখন শত দরিদ্রতার মধ্যেও ভীষণ ভালো লাগে।
রূপসা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবাইয়া তাসনিম বলেন, কুশারীরা খুবই অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ। এক সময় তাদের জমিদারি ছিল। ছিল বিপুল অর্থ-বিত্ত ও প্রচুর ভূসম্পত্তি। কিন্তু তারা বর্তমানে অনেক কষ্টে থাকলেও কারো কাছে মুখ ফুটে আর্থিক সাহায্য চান না। এটা আমাদের জন্য একটি সমস্যা। আমরা চেষ্টা করব কিভাবে তাদের সাহায্য দেয়া যায়। এ ছাড়া সরকারিভাবে ২২ শ্রাবণ পিঠাভোগে বিশ^কবির প্রয়াণ দিবসও পালনের চেষ্টা করব। কারণ পিঠাভোগই বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল শেকড়।

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল