২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

লোডশেডিংয়ে দুর্ভোগ সারা দেশে

চাহিদার ৩৯ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ বিদ্যুৎকেন্দ্রে
-

চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিদ্যুতের লোডশেডিং তীব্র আকার ধারণ করছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবেই গতকাল বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা থেকে সর্বোচ্চ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার মেগাওয়াট কম ধরা হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়া ও এলএনজি আমদানি কমানোর ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর গ্যাসের চাহিদার মাত্র ৩৯ শতাংশ সরবরাহ করা হয়েছে। এর ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতার পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আর এর প্রভাব পড়েছে মামগ্রিক উৎপাদনে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় শহর বা গ্রামে লোডশেডিংয়ের তেমন ভেদাভেদ নেই। আগে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি সমন্বয় করা হতো গ্রামে বিদ্যুৎ কম সরবরাহ করে। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে গ্রামের সাথে শহরেও সমানতালে লোডশেডিং করা হচ্ছে। এমনিতেই ভ্যাপসা গরম, তার উপর লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের গতকালের বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের প্রতিদিনের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গতকাল পিকআওয়ারে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। আর সর্বোচ্চ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা দেখানো হয়েছে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ পিডিবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যেই ঘাটতি দেখানো হয়েছে ১ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ উৎপাদনের এ ঘাটতির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে না। এমনিতেই চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে আগে থেকেই ঘাটতি ছিল, কিন্তু এখন তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি কমানোর ফলে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি বড় আকারে দেখা দিয়েছে।
গতকাল পেট্রোবাংলার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গতকাল দেশে ২৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা হয়েছে। পাশাপাশি এলএনজি আমদানি করা হয়েছে ৫০ কোটি ঘনফুট। সবমিলে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে ২৮০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু গতকাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের চাহিদা ছিল ২২৫ কোটি ঘনফুট। বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ৮৭ কোটি ৯৫ লাখ ঘনফুট। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র ৩৯ শতাংশ। গ্যাস সরবরাহ ব্যাপক হারে হ্রাস পাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
পিডিবির এক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দেশের মোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫২ শতাংশই গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু পেট্রোবাংলা চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে না পারায় উৎপাদনের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। তবে, পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদন ঠিক থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ও ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে এলএনজি আমদানি কমানো হয়েছে। বিশেষ করে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত মে মাসে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কিনতে প্রতি মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিটের দাম ছিল ২৬ মার্কিন ডলার। এখন এর দাম ৩৬ ডলারেরও বেশি। এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেই মূলত স্পট মার্কেট থেকে আমদানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
ডিপিডিসির নির্বাহী পরিচালক বিকাশ দেওয়ান গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, দিনের তুলনায় রাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ভালো হয়েছে। এর পরেও চাহিদার তুলনায় ঘাটতি থাকবে ৫০ থেকে ৬০ মেগাওয়াট। তবে, দিনে ঘাটতি ছিল বেশি।
পিডিবির জনসংযোগ পরিদফতরের পরিচালক সাইফুল হাসান চৌধুরী বলেন, গতকাল পিক টাইমে সারা দেশে দৈনিক ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে। কিন্তু সর্বোচ্চ উৎপাদন ধরা হয়েছে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। রাতের পিকআওয়ার শেষে বলা যাবে প্রকৃত ঘাটতি কত ছিল। তিনি জানান, আগে উৎপাদন ঘাটতি ছিল না, তাই লোডশেডিংও ছিল না। কিন্তু এখন আমরা ঘাটতিতে আছি। এ অবস্থা কিছুদিন চলবে বলে তিনি মনে করেন।
এদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং গতকাল রাজধানীসহ সারা দেশে তীব্র আকার ধারণ করেছে। গ্রামে এলাকা ভেদে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া গেছে। সেই সাথে রাজধানীতেও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিং। গতকাল এলাকা ভেদে গড়ে ৩ থেকে চারবার লোডশেডিং হয়েছে। প্রতিবার আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে। গ্রাহকরা জানিয়েছেন, বিদ্যুতের জন্য তারা বাড়তি মূল্য দিচ্ছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। এতে একদিকে তাদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে, অপরদিকে তাদের বাড়তি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। রাজধানীর রামপুরা এলাকার বাসিন্দা নাজমা হাসিনা বেগম বলেন, দিনে অন্তত ৪-৫ বার বিদ্যুৎ চলে গেছে। রাতেও সমান তালে বিদ্যুৎ চলে যায়। এ কারণে তিনি রাতে ঘুমাতে পারেননি।
চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ আসে আর যায় : সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ২০টি। আর এসবের বর্তমান উৎপাদনক্ষমতা ২৩৮২ মেগাওয়াট। কিন্তু গত সোমবার দিনের বেলায় ১১২৯ মেগাওয়াট এবং ইভনিং পিকআওয়ারে ১৩১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। গ্যাসসঙ্কটের কারণে ৫৮৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ। কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৫টি ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদনও হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আবার নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় গ্রিডে। ভ্যাপসা গরম ও বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার ভেলকিবাজিতে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ যন্ত্রণা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।
বিভিন্ন শিল্প কারখানার তথ্যানুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় গড়ে ৭-৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকতে হয়। আবার সাধারণ্যের হিসাবে তা আরো বেশি। বিদ্যুৎসঙ্কটে চট্টগ্রামের শিল্প কারখানার উৎপাদনে যেমনি বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে, তেমনি জনমনে তীব্র অস্বস্তি শুরু হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রফতানিমুখী শিল্প কারখানাগুলো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। গ্যাসসঙ্কটের কারণে চট্টগ্রামের বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র ২১০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতা সম্পন্ন রাউজান তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২ নম্বর ইউনিট এবং শিকলবাহা ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিকলবাহা ১৫০ মেগাওয়াট পিকিং বিদ্যুৎকেন্দ্র গ্যাসসঙ্কটের কারণে শাটডাউনে থাকায় পরিস্থিতির তীব্র অবনতি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সূত্র জানিয়েছে, কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিটের মধ্যে দু’টি ইউনিটে ৪০ মেগাওয়াট করে ৮০ মেগাওয়াট এবং অপর ৩টি ইউনিটের ৫০ মেগাওয়াট করে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু গত সোমবার পাঁচটি ইউনিট মিলে সর্বোচ্চ ১২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে। এ ছাড়া রাউজান তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১ নম্বর ইউনিটের বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতানুযায়ী ১৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়ার কথা থাকলেও গ্যাসসঙ্কটের কারণে উৎপাদন অর্ধেকে অর্থাৎ ৯০ মেগাওয়াটে নেমে এসেছে। পেট্রোবাংলার তথ্যানুযায়ী চট্টগ্রামের গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের চাহিদা ১৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ দেয়া হচ্ছে মাত্র ৩০.৬ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে কাফকো এবং সিইউএফ সারকারখানা দু’টির ১১৫ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে ৮৬.৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়া হচ্ছে।
পিডিবি সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামে প্রায় ১৫ শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ মিলছে এক হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। পিডিবির জাতীয় গ্রিড থেকে সরাসরি এই লোডশেডিং করা হচ্ছে বলে সূত্র জানায়। এ ছাড়া মেনটেনেন্সের নামে স্থানীয়ভাবেও লোডশেডিং করা হয়। ফলে দৈনিক লোডশেডিংয়ের পরিমাণ কত তাও হিসাব মিলানো দায় হয়ে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যুতের অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারণে বিজিএমএইএর সদস্যভুক্ত গার্মেন্টকারখানা, চট্টগ্রাম ইপিজেডস্থ শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং গার্মেন্টস শিল্পের প্রচ্ছন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সেক্টরের খাতের রফতানিমুখী প্রায় দেড় সহস্রাধিক শিল্প কারখানার শুধুমাত্র জ্বালানি তেল কিনতেই দৈনিক কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে হচ্ছে বলে জানা গেছে। এতে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে।
একাধিক ব্যবসায়ীর সাথে আলাপ করে জানা গেছে, চট্টগ্রামে শিল্প কারখানার জন্য প্রকৃতপক্ষে কত বিদ্যুৎ প্রয়োজনের সঠিক পরিসংখ্যান পিডিবির কাছে নেই। ফলে যথাযথ লোড ম্যানেজমেন্ট সম্ভব হচ্ছে না বলেও এসব ব্যবসায়ী মন্তব্য করেন।
ভুক্তভোগী নাগরিকরা জানান, গত বেশ কিছু দিন ধরে বন্দর নগরীতে বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার ভেলকিবাজি চলছে। অসহনীয় লোডশেডিং আর ভ্যাপসা গরম জন-জীবন অতিষ্ঠ করে তুলছে। বিদ্যুতের অভাবে ওভারহেড ট্যাংকে পানি তুলতে না পারায় দেখা দিচ্ছে পানির সঙ্কটও।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামস্থ পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী (সিস্টেম কন্ট্রোল) আবুল ফাত্তাহ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, জ্বালানি সঙ্কটের কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না বলে কিছু কিছু শেডিং করতে হচ্ছে। ন্যাশনাল গ্রিডকে রক্ষা করতেই এই লোডশেডিং জানিয়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রামে চার শ’ মেগাওয়াটের কাছাকাছি লোডশেডিং করা হচ্ছে।
সিলেটে সকালে যায়, আসে রাতে : ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে সিলেট। তেল ও গ্যাস সঙ্কটে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) কর্মকর্তারা। তারা বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেলসঙ্কট দেখা দেয়ায় তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং বিবিয়ানা গ্যাস প্ল্যান্ট শাটডাউন করায় গ্যাসের অভাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে চাহিদার চেয়ে এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে। এ ঘাটতি পূরণে সিলেটের ন্যায় সারা দেশে লোড ভাগ করে দেয়া হচ্ছে।
এক ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং করে ৩০ মিনিট করে বিদ্যুৎ দেয়া হচ্ছে। এ কারণে লাখ লাখ গ্রাহককে লোডশেডিংয়ের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। একটানা লোডশেডিংয়ে ও আষাঢ়ের ভ্যাপসা গরমের মধ্যে বৃদ্ধ ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যুতের অভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
সিলেটের বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত জনজীবন। সিলেটে প্রতিদিন কমপক্ষে সাত থেকে আট ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর লোডশেডিং বেশি হয়। শহর থেকে গ্রাম, সবখানে ভয়াবহ লোডশেডিং। গ্রামে রাতদিন সমানতালে চলে লোডশেডিং। গত কয়েক দিনের ভ্যাপসা গরমে জনজীবন যখন অতিষ্ঠ, তখন বিদ্যুতের এমন আসা-যাওয়ার লুকোচুরি খেলায় চরম বেকায়দায় পড়েছেন মানুষজন।
এদিকে শহরের বিভিন্ন এলাকাগুলো পিডিবির অধীনে থাকায় অনেকটা রুটিন করে লোডশেডিং করা হয়। তবে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীনে থাকা গ্রামীণ জনপদের মানুষকে কঠিন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গ্রামে ২৪ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎহীন থাকে বলে অভিযোগ করেন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দাদের। রোববার থেকে লোডশেডিংয়ের মাত্রা আরো বেড়ে গেছে বলেও জানিয়েছেন গ্রামীণ জনপদের লোকজন।
সূত্র মতে, গ্রামীণ জনপদে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সবখানে লাইন টেনে দিয়েছে। কিন্তু গ্রাহকের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ দিতে পারছে না। এ কারণে লোডশেডিং লেগেই থাকে গ্রামাঞ্চলে। বন্যায় বিপর্যস্ত জনপদে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ লোডশেডিং।
এমনিতে বন্যার কারণে পক্ষকাল সিলেটের অধিকাংশ গ্রামই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা থেকে বঞ্চিত ছিল। শুধু বিদ্যুৎ নয় সিলেটের আকাশে সূর্যের দেখাও মিলেনি ২০ দিন। বৃষ্টি কমলে গত ২ জুলাই থেকে প্রখর রোদে পুড়েছে প্রকৃতি, তাপমাত্রাও বেড়েছে। ভ্যাপসা গরমে দুর্বিষহ জনজীবন। এর মধ্যে এসএসসি পরীক্ষারও প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এ অবস্থায় মানুষকে বিপাকে ফেলেছে লোডশেডিং।
সিলেটের বিয়ানীবাজার পৌরসভার বাসিন্দা আব্দুল হালিম হেলাল বলেন, দিনে রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকতে হয়। অভিযোগ দিলে যেন আগুনে ঘি ঢালা হয়, এদিন আর বিদ্যুতের আলো থেকে বঞ্চিত থাকেন পুরো এলাকার মানুষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার) থেকে চাহিদার তুলনায় গ্রিড কন্ট্রোল রুম থেকে সরবরাহ কম দেয়া লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়েছে। আর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও শিল্প কারখানাগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রেখে গ্রাহক পর্যায়ে সঞ্চালন কেন্দ্রগুলোতে কম সরবরাহ দেয়াতে লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
এ বিষয় সিলেট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর পরিচালক আব্দুল আহাদ বলেন, গত ২-৩ দিন থেকে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। তবে খুব শিগগিরই গ্রাহকপর্যায়ে এই সমস্যা হবে আশাবাদী তিনি। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বিতরণ বোর্ড সিলেটের প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল কাদের বলেন, এখন চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। তাই ঘাটতি থাকার কারণে ৩৩ হাজার কেভি লাইনও বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এ কারণে বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জে ৫ লাখ গ্রাহকের চাহিদা পিক আওয়ারে ৪৫০ এবং অফপিক আওয়ারে ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সে তুলনায় সরবরাহ কম রয়েছে। তিনি বলেন, লোডশেডিংয়ের এ সমস্যা কেবল সিলেটে নয়, দেশের সবখানে। জ্বালানি সঙ্কটের কারণে তেলের যে পাওয়ার স্টেশনগেুলো পুরোপুরি বন্ধ। সিলেটের কুমারগাঁও এইচএফ ফুয়েলে চলা ৫০ মেগাওয়াট আগে থেকে বন্ধ রয়েছে। বিশেষ করে সিলেটে প্রায় ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়ে জাতীয় গ্রিডে যায়। সেখান থেকে চাহিদার বিপরীতে বণ্টন করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ১৬ হাজার মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক। আর ২০ হাজার মেগাওয়াট হলেও জেনারেশনে থাকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট।
সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ বিদ্যুৎ সঞ্চালন কেন্দ্র ৪৮ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সোমবার ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করে জাতীয় গ্রিড নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। এদিন সকালে সরবরাহ ছিল ১৫ মেগাওয়াট।
সঞ্চালন কেন্দ্রের সংশ্লিষ্টরা জানান, চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কম থাকলেও আনব্যালান্সড হয়ে পড়ে। তখন বিদ্যুৎ আপ-ডাউন করে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে সরবরাহ ঠিক রাখতে গিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে লোডশেডিং করতে হয়।
জানা গেছে, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ৯০ মেগাওয়াটের দু’টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। এর একটি উৎপাদনে আছে। অন্যটি বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া কুশিয়ারা ম্যাক্স পাওয়ার প্ল্যান্ট ১৭০ মেগাওয়াট, বারাকাতউল্লাহ ডায়নামিক পাওয়ার প্ল্যান্ট ৫১ মেগাওয়াট, হোসাফ এনাটিক প্রিমা ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করে। এর বাইরে সিলেটের কুমারগাঁও পিডিবির ১৫০ ও ৫০ এবং হোসাফের ৫০ মেগাওয়াট এবং শাহজিবাজারে ৪০০ মেগাওয়াট, বিবিয়ানায় ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়ে জাতীয় গ্রিডে যায়। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অধিকাংশ গ্যাস ও এফ ফুয়েল ভিত্তিক। এই জ্বালানি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর এ খাতে সঙ্কট দেখা দেয়ায় জাতীয়ভাবে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বাড়ছে।


আরো সংবাদ



premium cement